স্বদেশ প্রেম, দেশাত্মবোধ, দেশপ্রেম, জাতীয় জীবনে স্বদেশপ্রেমের গুরুত্ব

স্বদেশ প্রেম / দেশাত্মবোধ

দেশাত্মবোধ
দেশপ্রেম
জাতীয় জীবনে স্বদেশপ্রেমের গুরুত্ব

ভূমিকা : নিজের দেশকে ভালোবাসে না এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া  এক অসম্ভব ব্যাপার। দেশপ্রেম বলতে বোঝায় নিজের দেশকে এবং দেশের মানুষকে ভালোবাসা। দেশপ্রেমের মাধ্যমে ব্যক্তির নীতি নৈতিকতা ফুটে ওঠে এমনকি প্রকাশ পায় তার সহজাত গুণ। দেশকে ভালোবাসার মাধ্যমে নিজের মনুষ্যত্ব প্রকাশ করা যায়। শুধু মুখে প্রকাশ করলে হবে না যে আমি দেশকে ভালোবাসি, মুখে যা বলি তা মনে প্রাণে পালন করতে হবে। আচ্ছা বক্তৃতার মঞ্চে আলোচনার টেবিলে দেশপ্রেম দেশপ্রেম বলে ধ্বনি তুললে কি সে দেশপ্রেমিক হয়ে যাবে? অবশ্যই না, যখন কোন ব্যক্তি তার কাজের দায়িত্ব কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে পারবে তখন দেশপ্রেমে প্রকাশ পাবে। দেশপ্রেমের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে দেশ আমাকে কি দিল সে চিন্তা না করে আমি দেশকে কি দিতে পারছি তার হিসাব আগে করা প্রয়োজন। 

স্বদেশ প্রেমের স্বরূপ : স্বদেশ প্রেম ব্যক্তির এক মহৎ গুণ। স্বদেশ প্রেমের মাধ্যমে আকৃপণতার দিক তুলে ধরে। মানুষের দেশপ্রেম প্রকাশ পায় নিজ দেশের ইতিহাস – ঐতিহ্যকে এবং ভাষা সাহিত্যকে ভালোবেসে। এডউইন আর্নল্ড যিনি একজন ইংরেজি সাহিত্যের কবি তিনি দেশপ্রেমের এক অনন্য রূপ তুলে ধরেছিলেন– তিনি জীবনকে ভালোবাসতেন ঠিকই তবে দেশের চেয়ে বেশি নয়। মোটকথা ব্যক্তির সরলতা,দায়িত্ব-কর্তব্য,সততা,ন্যায় – নীতির মাধ্যমে প্রকৃত দেশপ্রেম ফুটে ওঠে। 

দেশপ্রেমের প্রকাশ ও দৃষ্টান্ত : দেশকে দেশপ্রেমিকই ভালোবাসে। এমনকি দেশের প্রতি মায়া-মমতা টান কেবল মাত্র দেশপ্রেমিকেরি থাকে। দেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য নির্দ্বিধায় জীবন উৎসর্গ করেন। যেমন বলি উপমহাদেশের শেরেবাংলা একে ফজলুল হক, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী,তিতুমীর প্রমুখ, মহাত্মা গান্ধী নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়ে দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখে গেছেন। অন্যদিকে বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আত্মবিসর্জন দিয়েছিলেন সাংবাদিক,ছাত্র-শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী সহ লক্ষ লক্ষ মা বোন। এটাই হচ্ছে প্রকৃত দেশপ্রেমের  ইতিহাসে পৃথিবীর এক দৃষ্টান্ত বিরল। 

দেশপ্রেমের উপায় : ইসলাম ধর্মে প্রকাশ পেয়েছে যে দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। পৃথিবীতে এমন কোন ধর্ম খুঁজে পাওয়া খুবই মুশকিল যে ধর্ম দেশকে ভালোবাসার নির্দেশ দেয়নি। প্রতিটা ব্যক্তি যেকোনো স্থানে বা  যেকোনো সময় দেশকে ভালবাসবে। প্রকৃত দেশপ্রেমের পরিচয় দেওয়া যায় দায়িত্ব কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করার মাধ্যমে। মানুষকে ভালোবাসার মাধ্যমে স্বদেশ প্রেমের পরিচয় দেওয়া যায় এমনকি সুন্দর ব্যবহার,নীতি নৈতিকতা, আদব-কায়দা, দয়ালু ইত্যাদি স্বদেশপ্রেমকে নির্দেশ করে। 

দেশপ্রেম উদ্বুদ্ধকরণে আমাদের করণীয় নির্দেশ : প্রতিটি মানুষের জীবনে জন্মলগ্ন থেকেই তার মাঝে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। মা যেমন সন্তানকে বুকে আগলে রাখে, তেমনি আমাদের সকলের উচিত দেশকে আগলে রাখা, দেশকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসা। দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা। উদ্ধুদ্ধকরণের মাধ্যমে আমরা স্বদেশপ্রেমকে জাগিয়ে তুলতে পারবো। দেশপ্রেমে উদ্ধুদ্ধকরণের যে উদ্যোগ গুলো নিতে হবে তার নিম্নরূপ –
১| দেশ আমাকে কি দিচ্ছে সে চিন্তা না করে আমি দেশকে কি দিতে পারছি সে চিন্তাটুকু আগে করা দরকার,
২| দেশের প্রতি ভালোবাসার অনুভূতি জাগিয়ে তোলা,
৩| দুর্নীতি অন্যায় অবিচারকে কখনো প্রশ্রয় না দেওয়া,
৪| সকলের নিজ নিজ কাজের দায়িত্ব-কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করা,
৫| দেশের যে আইনকানুন রয়েছে তা প্রত্যেকের মেনে চলা,
৬| নিজ স্বার্থকে উপেক্ষা করে দেশে এবং দেশের মানুষের জন্য কাজ করা। 

দেশপ্রেম, রাজনীতি ও সমাজনীতি : স্বাধীনতা অর্জনের জন্য রাজনীতিবিদরা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন এমনকি দেশের জন্য বছরের পর বছর অন্ধ কারাগারে বন্ধি ছিলেন। কিন্তু বর্তমানে দেশে সেই আদর্শিক রাজনীতির ধার আর নেই বললেই চলে। এখনকার দেশের পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে রাজনীতিবিদদের কাছে দেশ বা জনগণের কল্যাণ সাধন করাটা মূল বিষয় নয়। তাদের কাছে এইটাই মূল হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা তাদের চাই, এমনকি তারা ব্যস্ত কীভাবে তাদের গদি/আসন টিকিয়ে রাখবে। ক্ষমতাসীনদের কাছে কেবলমাত্র দেশ ও জনগনের কল্যাণ সাধন যেন তাদের মুখের ফাঁকা বলি। হরতালের নাম করে রাজনৈতিক অধিকার বাস্তবায়নে চলছে চরম অরাজকতা। বাস বা ট্রেন, এমনকি বিভিন্ন যানবাহনে আগুন দিয়ে মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করছে। রাজনৈতিক দল গুলোর এমন আচরণের ফলে স্বদেশ প্রেম আজ লজ্জিত। সমাজনীতিতে পচন ধরছে রাজনীতিবিদের এই দুর্নীতি এবং কুকর্মের ফলে এমনকি তারা নিজেদের আদর্শ দিয়ে নয়,সমাজ চালাচ্ছে অর্থ,বিত্ত ও পেশী শক্তির ক্ষমতায়। ন্যায়-নীতিকে দূরে সরিয়ে দিয়ে অন্যায় – অত্যাচার অরাজকতা, ও কুকর্ম যেন তাদের কাছে এক নিত্য দিনের রুটিন। 

দেশপ্রেম ও নৈতিক আদর্শ : কেবল আদর্শবান ব্যক্তিই পারে নিজেকে খাঁটি দেশপ্রেমে নিয়োজিত করত, দেশ ও দেশের জনগণের কল্যাণ সাধন করতে, অন্যায় ও দূর্নীতিকে দূরে ঠেলে দিয়ে নৈতিক-আদর্শ, সততা, দায়িত্ব-কর্তব্যের মাধ্যমে সুন্দর দেশ গড়তে। সত্যিকারের দেশ প্রেমিক ক্ষুদ্র স্বার্থকে উপেক্ষা করে জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করে যান। এমনকি প্রকৃত দেশ প্রেমিক এমন কোন অন্যায় কাজ করেন না যার ফলে দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। দেশের নাশকতাকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া। সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করে নৈতিকতার ভিত্তিতে দেশকে সুন্দর সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলা।

দেশপ্রেমের উগ্রতা : দেশ প্রেম হলো জাতি ও সমাজের উন্নত বৃত্তি। অন্যদিকে অন্ধ দেশপ্রেম ও উগ্র জাতীয়তা  জন্য বয়ে আনে এক ভয়াবহ সর্বনাশ। স্বদেশিকতার উগ্রতায় হতে পারে রক্তক্ষরণ, বিশ্বযুদ্ধ, হানাহানি, এই উগ্রতায়ী মানুষের জন্য বয়ে আনে অকল্যাণ ও চির অশান্তি। এ নেশা খুবই ভয়ংকর যা মানুষের সুবুদ্ধি কে আচ্ছন্ন করে। যার ফলে জাতিতে জাতিতে বিভেদ সৃষ্টি হয়।  বয়ে নিয়ে আসে ধ্বংস। 

স্বদেশ প্রেম মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ : দেশপ্রেম মানব জীবনে একটি অমূল্য সম্পদ। ব্যক্তির মহৎ গুণ প্রকাশ পায় দেশপ্রেমের মাধ্যমে। প্রতিটি ব্যক্তির দেশের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য ভালোবাসা থাকা উচিত। ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করে সার্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসাই হচ্ছে প্রকৃত দেশপ্রেম। এজন্য প্রতিটি দেশপ্রেমিকের উচিত দেশ ও জাতির জন্য কিছু না কিছু অবদান রেখা।  

উপসংহার : দেশ ও দেশের জনগণের প্রতি ভালোবাসা হীন ব্যক্তি হচ্ছে নরাধম।ইসলাম ধর্মে দেশপ্রেমকে ঈমানের অঙ্গ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে সকাল সন্ধ্যা “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি” শুধু মুখে ধ্বনি তুললে চলবে না,তা কাজের মাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে যে আমি দেশকে ভালোবাসি।  দেশপ্রেমের যে ধারণাগুলো দেহ ও মনে প্রানে লালন করতে হবে। চাকরিজীবীরা সততার সাথে তার দায়িত্ব – কর্তব্য পালন করবে, কৃষক জমির উৎপাদন বাড়াবে, রাজনীতিবিদরা দূর্নীতি, অসৎ উপার্জন ও কুকর্ম থেকে বিরত থাকবে। এভাবে সকলের কথা ও কাজের মিল রেখে চললে তবেই সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিনত হবে আমাদের প্রাণের বাংলাদেশ, যার ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে, তবেই আমরা হতে পারবো গর্বিত দেশপ্রেমিক।

 

স্বদেশ প্রেম PDF Format

 

 

অন্যান্য রচনা
সড়ক দুর্ঘটনা ও তার প্রতিকার
শ্রমের মর্যাদা
মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার

Facebook
Pinterest
Reddit