অথবা ঋতুচক্র ও বাংলাদেশ
ভূমিকা : বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়েছেন —
“কোন বনেতে জানিনে ফুল গন্ধে এ মন করে আকুল/ কোন গগনে উঠেরে চাঁদ এমন হাসি হেসে।
আঁখি মিলে তোমার আলো, প্রথম আমার চোখ জুড়ালো / ওই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে।”
কবির বাণী সার্থক। বাংলাদেশকে প্রকৃতির সুরম্য লীলা নিকেতন বললে মোটেই অত্যুক্তি হবে না। লীলাময় প্রকৃতি এখানে মুক্ত হস্তে সৌন্দর্য ও মাধুর্য বিতরণ করে।
ঋতুবৈচিত্র্য : যেসব লোকেরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যতায় নিজেকে আবিষ্কার করতে চান, তাদের কাছে এদেশের বৃক্ষ বটছায়া, নির্মল আকাশ, পুষ্প-পল্লব, নদীকান্তার, সুশীতল পল্লি বীথিকার এক অপূর্ব আবেদন রয়েছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা প্রভৃতি নদী বাংলার বুকে লীলায়িত ভঙ্গিতে বহমান। বাংলা এক সবুজ শস্য শ্যামল দেশ। আমরা পাখি ডাকে ঘুমিয়ে পড়ি, পাখির ডাকে জাগি। সুরের আনন্দে আমাদের ঘুমন্ত মন জেগে ওঠে। অরণ্য-ছায়া ও পুষ্প মঞ্জুরীর এমন মাধুর্য মানব প্রকৃতির সাথে পশু পাখির এমন অকৃত্রিম সোহার্দ জগতে অতুলনীয়। এখানে মানুষের চেহারায় যেমন বৈচিত্রের সমাবেশ ঘটেছে, তেমনি প্রকৃতির মাঝেও বৈচিত্রের অভাব নেই। ঋতুভিত্তিক বাংলার রূপ হয় পরিবর্তিত।
গ্রীষ্ম : বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এ দুই মাস মিলে গ্রীষ্মকাল। গ্রীস্মের খররৌদ্রে যে শান্ত প্রকৃতি অশান্ত দুর্দম আবেগে ফেটে পড়তে পারে তা বাংলার কালবৈশাখী যে না দেখেছে সে বুঝবে না।
বর্ষা : আষাঢ়ষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুই মাস মিলে বর্ষাকাল। বর্ষার ধারাবর্ষণ জগতের যত কথা, আজ সব ডুবিয়ে মূক প্রকৃতির কন্ঠে এনে দেয় মুখখরতা। চারিদিকে শোনা যায় ঝিল্লি দাদুরীর একটানা ডাক, মেঘবারে দিকে দিকে নেমে আসে অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের বুকে মাঝে মাঝে দেখা যায় বিদ্যুতের ঝলক। এমন করে অবিরল ধারাবর্ষণের মধ্য দিয়ে বিকশিত বনরাজির সজল গন্ধে বিদায় নেয় বর্ষা প্রকৃতি।
শরৎ : ভাদ্র-আশ্বিন মাস মিলে শরৎকাল। এ সময় আকাশে থাকে সাদা মেঘের ভেলা। মানুষ শারদীয়া প্রকৃতিকে অভ্যার্থনা জানিয়ে বলে,
“আমরা বেধেছি কাসের গুচ্ছ / আমরা গেঁথেছি শেফালী মালা
নবীন ধানের মঞ্জুরী দিয়ে / সাজিয়ে এনেছি ডালা।”
হেমন্ত : কার্তিক-অগ্রহায়ণ এই দুই মাস মিলে হেমন্তকাল। বাড়ির চারিদিক পাকা ধানের গন্ধে মুখরিত হয়। কৃষাণীরা গৃহস্থলীর সব কাজ রেখে ধান ঝাড়াই-বাছাইয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এ সময়ে বাংলার ঘরে ঘরে হয় নবান্ন উৎসব, চলে পিঠাপুলির নিমন্ত্রণ।
শীত : পৌষ এবং মাঘ মাসে শীতের তীব্রতা বেশি থাকার ফলে বাংলায় এই দুই মাস কে বলা হয় শীতকাল। উৎসব প্রমত্ত ধরণীর অঙ্গে শীত বুলিয়ে দেয় তার শীতল ছোঁয়া। ধরণী জড়-বিবশ হয়ে পড়ে। ক্রমে শীত দূরে সরে যায়।
বসন্ত : ফাল্গুন ও চৈত্র মাস মিলে বসন্তকাল। মানুষের আকাঙ্ক্ষার অবসান ঘটিয়ে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। এ সময় পাখির কল কাকলি দক্ষিণে হাওয়া আম্রমুকুলের গন্ধ আর ফুলের সমারোহ প্রভৃতি মিলে সৃষ্টি হয় অপূর্ব মায়ালোক।
গ্রীষ্মে বাংলার প্রকৃতি : বাংলাদেশের প্রকৃতির প্রথম ঋতু হলো গ্রীষ্ম। গ্রীস্মে চারিদিকের মাঠ ঘাট ধু-ধু করতে থাকে। সমস্ত জীবজগৎ ও উদ্ভিদ জগতে নেমে আসে এক প্রাণহীন, ক্লান্ত পথিকপথিক হাঁপিয়ে বিশ্রাম নেয় বট বৃক্ষের ছায়ায়। এসময় প্রচন্ড তাপে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে যায়। গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপে দেশবাসী হাঁপিয়ে ওঠে।
নবযৌবন সৃষ্টিশীল বর্ষার সৌন্দর্য : গ্রীস্মের পরে আসে বর্ষা। মৃতপ্রায় নদ-নদী গুলো আবারো পানিতে পরিপূর্ণ হয়ে যেন নবযৌবন লাভ করে। গাছপালা বৃষ্টির পানিতে আনন্দে মেতে ওঠে। প্রচন্ড বর্ষণে পল্লী জননীর বুকে বয়ে চলে জলের স্রোতের রূপ। বর্ষা প্রকৃতির সকল শূন্যতাকে সৃষ্টিতে পরিণত করে।
শরতের শুভ্র মেঘের ভেলা : শরতের আকাশে ভেসে বেড়াই শুভ্র মেঘের ভেলা। দেখে যেন মনে হয় কোন সুদূর পথ পাড়ি দিয়ে বাংলার রূপকে সৌন্দর্যে ভরিয়ে দেবার টানে মেঘগুলো ভেসে এসেছে বাংলার আকাশে। শরতের শুভ্র মেঘ মানুষের মলিনতাকে দূরে সরিয়ে মনে এনে দেয় পরম প্রশান্তি।
হেমন্তের উদারতা : হেমন্ত তার দুহাত উজাড় করে ফসলের ডালী সাজিয়ে রাখে বাংলার বুকে। চারিদিকে ফসল কাটা, ফসল ঘরে তোলার ধুম পড়ে যায়। কৃষকদের মুখে ফুটে ওঠে তৃপ্তির হাসি।
শীতের রূপ দৃশ্য : হেমন্তর পরে আগমন ঘটে শীতের। শুষ্ক ও রিক্ততায় বিষাদময় প্রতিমূর্তিতে শীতের আবির্ভাব ঘটে। এ সময়ে ধান কাটা মাঠে কী সীমাহীন শূন্যতা। মানুষের মনে থাকে আনন্দের ছোঁয়া। এ সময়ে ঘরে ঘরে পিঠাপুলির ধুম পড়ে যায়। নতুন খেজুর মিষ্টি মধুর সুভাষে পল্লীর আঙ্গিনা মধুময় হয়ে ওঠে। সমস্ত গ্রাম কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে সূর্যি মামা উঁকি দিতে থাকে, সাড়া পড়ে যায় জনজীবনে।
বসন্তের ফুলের সমাহার : বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্রের মধ্যে বসন্ত ঋতুকে বলা হয় ঋতুরাজ। কেননা হরেক রকম ফুলের সমাহার নিয়ে স্বাতন্ত্র্য রূপে আত্মপ্রকাশ করে ঋতুরাজ বসন্ত। চারিদিকে বইতে থাকে ফুলের মধুময় সুবাস। মৌমাছিরা উড়ে বেড়াই ফুলে ফুলে, পাখিরা ডালে ডালে গান গেয়ে ফেরে, মানব মানবের হৃদয়ে ভাবের দোলা লাগায় বসন্ত।
বাংলার বুকে সূর্যাস্তের দৃশ্য : গোধূলির বিদায় বেলায় সূর্যাস্তে বাংলার বুকে ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা। সূর্যের অস্তরাগে বাংলা জননী ধারণ করে এক অপরূপ দৃশ্য। রক্তিম আভা ছড়িয়ে নদী বা সমুদ্রের বুকে মিশে যায় সূর্য, আর বাংলার বুকে রেখে যাই সৌন্দর্যের অপরূপ ছোঁয়া।
বাঙালির জীবনে ঋতু বৈচিত্র্যের প্রভাব : বাংলার ঋতু বৈচিত্র্য এবং বাঙালির জীবন একই সূত্রে গাঁধা। প্রত্যেকটি ঋতুর প্রভাব রয়েছে বাঙালির জীবনে। ছয় ঋতুর রূপ, রস, গন্ধ,ও ছন্দ প্রত্যেকটি মানুষের মনকে প্রভাবিত করে।
বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি : শরতের শেফালী, শীতের শিশির ভেজা ঘাস, বসন্তের পুষ্প একমাত্র বাংলাদেশ ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। কুটির ঘেরা পল্লীগ্রাম। মাঠে সবুজের সমাহার। দিঘির পাড়ে সারি সারি নারকেল ও তালগাছ। এখানে বৈচিত্রের অভাব নেই। এদেশের জমিতে সৃষ্টি হয়েছে বন বনানীর সুবিসাল এলাকা। সুন্দরবন হতে শুরু করে বিশ্বের অন্যতম ব–দ্বীপ বাংলাদেশের সিলেট, খাগড়াছড়ি, পার্বত্য চট্টগ্রাম আর বান্দরবানে বনানীর সাথে মিলেছে পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য। রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক পাহাড়ের বুকে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের উৎস।
নদীমাতৃক বৈচিত্র : এদেশের নদ-নদী খাল-বিল বাংলা প্রকৃতি অন্যতম আকর্ষণ। বিশ্বের অন্য কোন দেশে এত নদ-নদী দেখা যায় না। বাংলাদেশের নদ-নদীর উপর দিয়ে চলে অসংখ্য নৌকা, লঞ্চ ও স্টিমার।পালতোলা নৌকা নদীর সৌন্দর্যের অন্যতম কারণ। মাঝির কন্ঠে তখন ভাটিয়ালি —
“একুল ওকুল দুকূল ভাঙ্গে উতাল পাতাল ঢেউরে / বৈঠা হাতে আমি একা সাথে নাই মোর কেউরে।”
উপসংহার : সত্যি অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী আমাদের এ দেশ, বিচিত্র রূপের মাঝে প্রকৃতির সৌন্দর্যের এক অনন্য লীলাভূমি। হিমালয়ের সুবিশাল বাঁধ কনকনে শীতকে আবদ্ধ করেছে। শীতে সবুজ ফসলের মাঠ ধারণ করে হলুদ বর্ণ। সরিষার ফুল সবুজকে পরাজিত করে। তাইতো গীতিকার লিখেছেন,
“একবার যেতে দেনা আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু কুহু দোয়েল ডাকে মুহু মুহু
নদী যেথায় ছুটে চলে, আপন ঠিকানায়।”
অন্যান্য রচনা
একটি গাছ একটি প্রাণ
কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪
একুশে ফেব্রুয়ারি