অথবা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও দায়িত্ববোধ
অথবা, জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
অথবা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ
অথবা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
অথবা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
অথবা, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম
ভূমিকা : এ পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন জাতির অভ্যুদয়ের কিংবা স্বাধীনতা অর্জনের একটি ইতিহাস আছে। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি স্বাধীন জাতি তাদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। কিন্তু এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে আছে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল। বাংলাদেশের মানুষ মুক্ত হয় বিদেশি শাসন-শোষণ, নির্যাতন-নিপীড়নের হাত থেকে। মুক্তিসংগ্রাম এদেশের মানুষকে পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্ত করে এনে দিয়েছে আত্মবিকাশের সুবর্ণ-সুযোগ। এজন্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতির প্রেরণা হয়ে থাকবে চিরকাল। যতদিন বাংলাদেশে থাকবে, বাঙালি জাতি থাকবে, ততদিন এ চেতনাই হবে বাঙালি জাতির সার্বিক উন্নতির মূলমন্ত্র।
মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ইতিহাস : মুক্তিযুদ্ধের পূর্বের ইতিহাস বলতে ছিল শুধু শোষণ ও বঞ্চনা। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর থেকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার অর্জনের আগ পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অধীনে ছিলাম। তাদের দ্বারা আমরা বহু বঞ্চনা, লাঞ্ছনার শিকার হয়েছি। আমাদের ভাষার উপর, গণতন্ত্রের উপর, এমনকি গণমানুষের উপর বারবার আঘাত এসেছে। এছাড়া আমাদের মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষণ বাঙালি সহ্য করেনি। তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে রক্ত দিয়ে বাঙালি জাতি তাদের নিজেদের ন্যায্য অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
আমাদের অস্তিত্বের উপর প্রথম আঘাত : আমাদের অস্তিত্বের ওপর প্রথম আঘাত হিসেবে আসে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা। ১৯৪৮ সালের গণপরিষদে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দিলে গণপরিষদের বাঙালি সদস্য এ ঘোষণাকে মেনে নেয়নি। তারা প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে। ১৯৪৮ সালে এক জনসভায় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর উর্দু এবং উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এ ঘোষনায় বাংলার বীর সন্তানেরা প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি এক ঝাঁক তাজা প্রাণের মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে দেশবাসীর উপর নেমে আসা আঘাতকে তীব্রভাবে প্রতিহত করে।
মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি : বাঙালির অতীত ইতিহাস মূলত ভিনদেশীদের শাসন-শোষণ আর জুলুমের ইতিহাস। বলা যায় প্রাচীন কাল থেকেই এদেশ শাসন করে আসছে ভিনদেশী। সেই শশাঙ্ক থেকে পাল ও সেনদের কথা বাদ দিয়ে মুঘল, ইংরেজ বা পাকিস্তানি যাদের কথাই বলি না কেন, তারা কেউ এ দেশের সন্তান ছিল না। মূলত তারা সবাই ছিল বিদেশি-বিভাষী। তারা এদেশে এসেছে নানা কারণে। কিন্তু এসে ছলে-বলে-কলে-কৌশলে দখল করেছে এদেশের শাসন ক্ষমতা। ইংরেজরা এদেশে আসে বাণিজ্য করতে। কিন্তু ইংরেজরা অচিরেই প্রসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ১৯৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর আম্রকাননে মীর জাফরের সহায়তায় নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজিত করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। আর সেদিনই অস্তমিত হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার সূর্য। তারপর প্রায় দু’শ’ বছর ইংরেজরা এদেশের মানুষের উপর চালায় শাসন-শোষণ নির্যাতনের স্টিম রোলার। তাঁদের সময় থেকেই অনেক বাঙালি বীর সন্তান বিভিন্ন সময়ে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছে। যেমন : ফকির বিদ্রোহের নেতা মজনু শাহ, বারাসাত বিদ্রোহের নেতা তিতুমীর, ফরায়েজী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং সর্বশেষ ১৯৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহকারী সৈনিকগণ। তাঁদের চেতনা ধারণ করেই উনিশ শতকে ভারতীয় বাঙালিরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে নানা আন্দোলন ও সংগ্রাম করে ১৯৪৭ সালে অর্জন করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র পাকিস্তান। কিন্তু ইংরেজরা বাঙালি জাতির উপর যেভাবে শাসন-শোষণ করত, পশ্চিম পাকিস্তানিরাও বাঙ্গালীদের উপর ঠিক সেভাবেই শাসন-শোষণ চালাতে লাগলো। পূর্ব-বাংলার মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের খেয়ালখুশির পুতুল,আর শোষণ বঞ্চনার পাত্র হয়ে গেল। ভাষা আন্দোলনের চেতনা ধরেই’ ৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে জয়, ৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, ৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এককভাবে বিজয় অর্জিত হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্র ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নানান টালবাহানা শুরু করে। সময় ক্ষেপণ করে ২৫ শে মার্চ রাতের আঁধারে এদেশের ঘুমন্ত মানুষের উপর বর্বর হামলা চালায় তারা; মূলত তাদের উদ্দেশ্য এদেশের অধিকার সচেতন মানুষকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেওয়া। কিন্তু বাঙালি হার মানা জাতি নয়। বাঙালি জেগে ওঠে দুর্বার সংগ্রামে। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতা যুদ্ধ। তারা বাঙালির প্রাণ মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার জন্য নানা ষড়যন্ত্র শুরু করল। আর তখনই বীরের জাতি বাঙালি গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠলো, সংগঠিত হলো ভাষা আন্দোলন। তারপর থেকেই জাগ্রত হলো তাদের মুক্তির চেতনা।
ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য আন্দোলনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : ‘ভাষা আন্দোলন’ হলো এদেশের মুক্তিসংগ্রামের মা। এ আন্দোলনই জাতিকে সর্বপ্রথম ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও অধিকার আদায়ের মূলমন্ত্র দীক্ষা দেয়। ১৯৪৮ সালে ভাষা কেন্দ্রিক এ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে এবং ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারিতে সালাম, বরকত, জব্বার, রফিক, শফিউর সহ আরো অনেকের রক্তের বিনিময়ে,প্রাণের বিনিময়ে ফলপ্রসূ হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন যেমন মানুষের মনে মুক্তির স্বাদ জাগরিত করে, তেমনি ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানসহ একের পর এক আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশ এগিয়ে যায় স্বাধীনতার পথে।
স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা : স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল বড়ই নাজুক। আর পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিরা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মারাত্মক বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। পূর্ব পাকিস্তানের সমাজ কাঠামো ছিল মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণিভিত্তিক। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সমাজকাঠামো ছিল ভূস্বামী-পুঁজিপতি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীভিত্তিক। পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক আচরণ ও পূর্ব পাকিস্তানের যোগ্য প্রতিনিধির অভাবে পূর্ব পাকিস্তানিরা অর্থনৈতিকভাবে শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। এমনকি সমস্ত কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। ১৯৪৭-১৯৭০ সাল পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের আমদানি খাতে ব্যয় করা হয় ৩৭৯৯ কোটি টাকা আর পূর্ব পাকিস্তানের ৬৩০ কোটি টাকা। এছাড়া শাসন খাতে পূর্ব পাকিস্তানের ২৬৯ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় ছিল ১৯৪৭ কোটি টাকা। উন্নয়ন খাতে পাকিস্তানের ব্যয় ২১১৪ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের ৫৩৯৫ কোটি টাকা। এই ব্যাপক বৈষম্যের কারণে বাঙালিরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আরো বেশি মরিয়া হয়ে ওঠে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু ও স্বাধীনতা ঘোষণা : বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরতরে মুছে দেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ কাল রাতে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া, টিক্কা খান। রাতের অন্ধকারে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বাহিনীকে তারা লেলিয়ে দেয় ঘুমন্ত নিরীহ বাঙ্গালীদের নিধন করতে। হিংস্র পাক-সেনাবাহিনী ঢাকার পিলখানা, ইপিআর হেডকোয়ার্টার, রাজার বাগ পুলিশ লাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্মম হত্যাকাণ্ড চালায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে নিয়ে যায় পশ্চিম পাকিস্তানে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের আগে ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাছাড়া ৭ ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে একটি জনসভায় তিনি জোরালোভাবে ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” এরপর ২৬ শে মার্চ চট্টগ্রামের কালুরঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। এ ঘোষণার সাথে সাথে সারা দেশের শুরু হয় মুক্তির সংগ্রাম।
মুক্তিবাহিনী ও মুজিবনগর সরকার গঠন : স্বাধীনতা সংগ্রামের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে সাবেক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, ব্যবসায়িক শ্রমিক, ছাত্র-যুবক, কৃষক-মজুরসহ প্রত্যেক শ্রেণীর প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মানুষ নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী। তারা দেশের অভ্যন্তরে ও দেশের বাইরে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে অবস্থান ও নামমাত্র ট্রেনিং নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুসৈন্যের ওপর। ১০ই এপ্রিলের ঘোষণা অনুযায়ী গঠন করা হয় স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার। বিপ্লবী সরকারের দপ্তরের কাঠামো ছিল নিম্নরূপ :
রাষ্ট্রপতি – শেখ মুজিবুর রহমান
উপ–রাষ্ট্রপতি – সৈয়দ নজরুল ইসলাম (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি)
প্রধানমন্ত্রী – তাজউদ্দীন আহমদ
পররাষ্ট্র মন্ত্রী – খন্দকার মোশতাক আহমদ
অর্থমন্ত্রী – ক্যাপ্টেন মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র ও পূর্ণবাসন – এ এইচ এম কামরুজ্জামান
সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক – জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী।
১৯৭১ সালে ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর জেলার ভবের পাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে বহু দেশে-বিদেশি সাংবাদিকের সামনে বিপ্লবী সরকার শপথ গ্রহণ করেন। এমনকি দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কে নিয়ে গঠন করা হয় একটি উপদেষ্টা কমিটি।
মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতা ও চূড়ান্ত বিজয় : দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী বাংলাদেশের জেগে ওঠা মানুষ তাদের জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে হায়েনা পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে। তারা সামান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে কাবু করে পাক সেনাদের। তাদের বিভিন্নভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে ভারত। শেষে প্রত্যক্ষভাবেই তারা মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে যোগ দেয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সমন্বয়ে গঠন করা হয় যৌথ বাহিনী। এ যৌথ বাহিনীর আক্রমণে পরাজিত হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ৯৩ হাজার সৈন্যসহ পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল নিয়াজি মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। সমাপ্তি ঘটে রক্তক্ষয় যুদ্ধের। বাংলার আকাশে আবার উদিত হয় লাল-টকটকে রক্তিম স্বাধীনতার সূর্য। বাঙালিরা পায় তাদের স্বাধীন দেশ, স্বাধীন ভাষা, স্বাধীন লাল-সবুজের পতাকা এবং চির কাঙ্খিত স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব : মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগ থেকে বাংলার মানুষের মাঝে এক নব চেতনার উন্মেষ ঘটে। এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাংলার সকল শ্রেণীর মানুষকে একতার বন্ধনে আবদ্ধ করে। বাংলার মানুষকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছে মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের ভিতরে আত্মোপলব্ধি ক্ষমতা জাগিয়ে তোলে মুক্তিযুদ্ধ। মোটকথা, বাংলার মানুষকে জাগিয়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব ব্যাপক। এই প্রভাব বর্তমানেও ছড়িয়ে আছে।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন : বাঙালিরা যে স্বপ্ন দেখে যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছিল, সেই স্বপ্ন গত চার দশকে বাস্তবের রূপ পায়নি। স্বাধীনতার পর থেকে বারবার সামরিক অভুত্থান, হ*ত্যা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল, অর্থনৈতিক বৈষম্য, দেশীয় বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের তৎপরতা, বেকারত্ব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, আইন শৃঙ্খলার অবনতি, দুর্নীতি ইত্যাদি সামাজিক অবক্ষয় স্বাধীনতার মূল লক্ষ্যকে ম্লান করে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিপন্ন করে চলেছে।
সামাজিক ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের প্রতিফলন : যুদ্ধের এই ভয়াবহতা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশের প্রায় এক যুগের মতো লেগে যায়। এরপর ক্রমাগত কৃষি ও বাণিজ্যিক অর্থনীতির ধারা উন্নতির দিকে ধাবিত হয়। দেশকে শিল্পে উন্নত করার জন্য শিল্প-কারখানাসমূহকে জাতীয়করণ করা হয়। এরপর সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে ছোট-বড় শিল্প-কারখানা। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য বর্তমানে অনেক ব্যাংক কাজ করে যাচ্ছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির এদেশের চা, পাটজাতপণ্য ও বস্ত্রশিল্প থেকে প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক অবস্থা মোটামুটি ভালো হলেও এদেশের গুটি কয়েক মানুষের হাতেই এই অর্থ গুলো বন্দী হয়ে আছে। যার ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বাস করছে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট খুবই ভয়ানক। যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের দেশ স্বাধীন করেছিল। মূলত সে স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেছে। স্বাধীনতার চার দশক পরেও সে স্বপ্ন এখনো অধরা রয়ে গেছে। সারাদেশে এখন ঘুষ, দুর্নীতি, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, রাজনৈতিক সংঘর্ষ ও দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে। শিক্ষাঙ্গনে রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ভয়ংকর রূপে দেখা দিয়েছে। এসব দেখে এখন কষ্ট হয়। এজন্যই এত কষ্ট করে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে দেশটা স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এদেশের প্রত্যেকটি দেশপ্রেমিক মানুষের মনে অত্যন্ত গভীরে প্রোথিত। দেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর সদ্যগঠিত সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বেতার ভাষণে বলেছিলেন, “আমরা অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি সেসব শহীদদের কথা, সেসব অসীম সাহসী বীর যোদ্ধার কথা, যাঁরা তাঁদের আত্মবলিদানের জন্য অমর হয়েছেন তারাই আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে চিরকাল।”
মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা বা চেতনা আজও আমাদের সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতিতে অম্লান এবং আশা করা যায় ভবিষ্যতেও তা অম্লানই থাকবে। কারণ ইতিহাস থেকেই শিক্ষা নেবে জাতি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এদেশের সর্বসাধারণ মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির মন্ত্রণা। এ মন্ত্রে উদ্দীপিত হয়ে কাজ করলে আমরা পাব অর্থনৈতিক মুক্তি। আর অর্থনৈতিক মুক্তি এলে তবেই সার্থক হবে আমাদের স্বাধীনতা।
উপসংহার : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদেশের ছাত্র-যুবক, কৃষি-শ্রমিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সৈনিক, নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ, হিন্দু-মুসলিম, খ্রিস্টান-বৌদ্ধসহ সকল শ্রেণীর মানুষের রক্তদানের স্মৃতি। রাজাকারদের কথাও স্পষ্ট করে লেখা আছে ইতিহাসে। ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ আর দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কোনোক্রমেই ভুলে গেলে চলবে না বরং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশ গঠনে ব্রতি হতে হবে প্রত্যেকটি মানুষকে। দেশের সকল শ্রেণীর মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক নিরাপত্তা ও মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দিতে পারলে তবে আসবে স্বাধীনতা অর্জনের প্রকৃত সার্থকতা ; সার্থক হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।
অন্যান্য রচনা
বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রতিকার
কৃষি কাজে বিজ্ঞান