অথবা, ঋতু বৈচিত্র্যে বসন্ত
ভূমিকা : বাংলাদেশ হলো ষড়ঋতুর দেশ। ছয়টি ঋতুর পালাবদলে এদেশের প্রকৃতি তার বৈচিত্র্যময় রূপ নিয়ে হাজির হয়। এ ছয়টি ঋতুর মধ্যে বসন্ত ঋতুকে বলা হয় ঋতুরাজ। কারণ বাংলাদেশের ঋতুচক্রের শেষ ঋতু এই বসন্ত। এটি মূলত বাংলার ষড়ঋতুর এক মনোমুগ্ধকর ঋতু। বসন্ত সাধারণত ফাল্গুন চৈত্র মাসজুড়ে থাকে। রিক্ত বনবীথির শাখায় শাখায় কচি সবুজ পাতারা আনন্দে মেতে ওঠে। সবুজ পাতা আর রঙিন ফুলে বসন্ত এভাবেই রাঙ্গায় প্রকৃতিকে।
বসন্তের স্বরূপ : শীতের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে প্রকৃতিতে আগমন ঘটে বসন্তের। ফাল্গুন-চৈত্র এই দুই মাস নিয়ে বসন্তকাল। শীতের রিক্ততাকে মুছে ফেলে বসন্ত প্রকৃতিতে এক নতুন প্রাণ দান করে। বসন্ত প্রকৃতিতে আসে প্রানের সঞ্জীবনী নিয়ে। সেই সঞ্জীবনী রসের সিক্ত হয়ে প্রকৃতি আড়মোড়া ভেঙ্গে জেগে ওঠে। গাছে গাছে কচি কচি সবুজ পাতা, ডালপালা ও নানা রঙের ফুল ফোটে। পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, মধুমালতী গন্ধে প্রকৃতিতে শুরু হয়ে যায় এক আশ্চর্য মাতামাতি।
বসন্তের স্থায়িত্ব : বসন্তকালে যেমন হাড় কাঁপানো শীত থাকে না, তেমনি গ্রীষ্মের উত্তপ্ত তেমন অনুভূত হয় না। বছরের এটি সবচেয়ে আরামপ্রিয় সময়। বসন্তের প্রকৃত স্থায়িত্বকাল অতি সামান্য। ফাল্গুন-চৈত্র এ দু’মাসকে বসন্তকালের স্থায়িত্বকাল বলা হলেও মূলত ফাল্গুন মাসেই বসন্ত ঋতুর প্রকৃত বৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে। কারণ চৈত্রের শুরুর দিক থেকেই গরম শুরু হয়ে যায়।
বসন্তের অনুভব : বসন্ত ঋতু প্রকৃতি ও মানুষের মনে নব আনন্দের সঞ্চার করে। প্রকৃতি যেমন বসন্তের ছোঁয়ায় নতুন রূপে সজ্জিত হয়, তেমনি মানুষের মনও বসন্তের রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। শীতের জড়তা ভেঙে মানুষ চঞ্চল হয়ে ওঠে। কবি, প্রকৃতিপ্রেমীরা বসন্তের বন্দনা গীতি রচনা করে। বসন্ত তার সীমাহীন রূপ নিয়ে লাভ করে সকলের সমাদর। বসন্তের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে কবিকণ্ঠে তাই বেজে ওঠে –
‘আজি দখিন দুয়ার খোলা
এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার বসন্ত এসো।
দিক হৃদয় দোলায় দোলা
এসো হে, এসো হে, এসো হে, আমার বসন্ত এসো।’
বসন্তের প্রকৃতির অবস্থা : শীতের কুহেলিকার পর্দা সরিয়ে মহুয়ার মালা গলায় পরে বসন্ত আসে প্রকৃতিতে। মাথায় তার কৃষ্ণচূড়ার মুকুট আর গলায় তার মাধবীলতার মালা। যেদিকে দৃষ্টি দেয়া যায় সেদিকেই যেন অপরূপ রূপে চোখ বিমোহিত হয়। বনে বনে নানা রঙের ফুল ফোটে-দক্ষিণা বাতাসে সেই ফুলের গন্ধে মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। কোকিল এসে বসে গাছের ডালে। ফুলের মনমাতানো সৌরভের মাঝে তার কুহুকুহু স্বর এক গভীর মায়াজালের সৃষ্টি করে। এ মায়াজাল প্রকৃতির অসীম রহস্যের উপলব্ধিই আমাদের মনে সৃষ্টি করে। বসন্তের এই প্রকৃতির রূপ সত্যিই মনমুগ্ধকর। দিনের শুরুতে বসন্তের এ অপরূপ সৌন্দর্য মানুষের মনে আনন্দ ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেয়। নিজের অজান্তেই মানুষ গেয়ে ওঠে বসন্তের গান।
বসন্ত ও কবিমন : কবি ও প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য বসন্ত বয়ে আনে এক নতুন মাত্রা। কবিরা স্বভাবতই প্রকৃতিপ্রেমী। বাংলার কবিদের এদেশের প্রকৃতির সঙ্গে রয়েছে এক মধুর সম্পর্ক। তাদের কবিতায় প্রায়ই উঠে আসে প্রকৃতির বর্ণনা বাংলাদেশের অনেক কবিই বসন্তের রূপে বিমোহিত হয়ে তাকে নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন, গান রচনা করেছেন।
বসন্ত উদযাপন : পহেলা ফাল্গুন উদযাপন আজ আমাদের বাঙালি সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে উঠেছে। ফাল্গুনের প্রথম দিনে প্রকৃতির মতো মানুষও বিশেষত তরুণ-তরুণীরা বর্ণিল সাজে সেজে ওঠে। তাদের পোশাকে থাকে হলুদ, লাল, সবুজ রংয়ের আধিক্য। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় অনেক জায়গায় আনুষ্ঠানিকভাবে পহেলা ফাল্গুন উদযাপিত হয়। এ উপলক্ষে আয়োজন করা হয় নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় প্রতিবছর বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে বসন্তকে বরণ করে দেয়। আস্তে আস্তে বসন্ত উদযাপনের রীতি দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে যাচ্ছে। পহেলা বৈশাখের মতো পহেলা ফাল্গুন ও বাঙালি সংস্কৃতির সাথে আঙ্গাআঙ্গিভাবে মিশে যাবে।
বসন্তের প্রভাব : বসন্ত ঋতুতে মূলত শীত, গ্রীষ্ম কোনোটিই প্রচন্ডতা থাকে না। এ সময় কনকনে শীত অথবা কাঠফাটা রোদ থাকে না। তাই এরকম পরিবেশে মানুষের দেহ ও মনে আসে নতুন উদ্যম। শীতের কঠিন পর্ব কাটিয়ে সবাই প্রাণে নব উদ্দীপনা নিয়ে কাজে লেগে যায়। কিন্তু ঋতু পরিবর্তনের কারণে মানুষ নানা রকম রোগে আক্রান্ত হয়। কলেরা, বসন্ত প্রভৃতি রোগের পাশাপাশি সর্দি জ্বরেও আক্রান্ত হয় অনেকে।
বসন্তের উপকারিতা : বসন্তকাল মানুষের জন্য ভীষণ আরামদায়ক। কারণ এই সময়ের আবহাওয়া না ঠান্ডা, না গরম। যেটাকে বলা হয় নাতিশীতোষ্ণ। এই সময় নানা ধরনের শস্য ও রসালো ফল পাওয়া যায়। সতেজ ফুল-ফল, ফসল, মলয় বায়ু এবং কোকিলের কুহুতান সব মিলিয়ে বসন্ত মোহনীয়।
উপসংহার : বাসন্তকে বলা হয় ঋতুশ্রেষ্ঠ বা ঋতুরাজ। এই নামের সার্থকতা তার সৌন্দর্যের মধ্যেই নিহিত। বসন্ত প্রকৃতির প্রতি আমাদের গভীর আকর্ষণ তৈরি করে। প্রাণ, মন, দৃষ্টি সর্বত্র বসন্ত ছড়িয়ে দেয় তার স্নিগ্ধতা,সৌন্দর্য। বসন্ত মানুষের মনে আনন্দ সঞ্চার করে। বসন্ত হলো যৌবনের প্রতীক, সে যৌবনের ঋতু। তাই যুগ যুগ ধরে মানুষ বসন্তের বন্দনা করে আসছে।