ভূমিকা : মানবজীবন নানা প্রকার রোগ, শোক, এবং জরাগ্রস্ততা নিয়ে পরিচালিত হয়। কোনো কোনো রোগ কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি হয়। আবার কোনোটি সৃষ্টি হয় প্রকৃতি থেকে। এসব রোগ ও জরাগ্রস্ততা মানুষকে মাঝে মাঝে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। প্রাচীনকালে চিকিৎসাব্যবস্থা উন্নত ছিল না। এজন্য মানুষ রোগে আক্রান্ত হলেই মৃত্যু নিশ্চিত ছিল। বর্তমান যুগে এই অবস্থার অবসান ঘটেছে। আধুনিক যুগে আমরা অনেক মরণব্যাধিকে জয় করেছি। তারপরও আধুনিক এই চিকিৎসার যুগে নানাবিদ মরণব্যাধি আমাদের চারপাশে অবস্থান করছে। এইসব মরণব্যাধির একটি হলো ডেঙ্গুজ্বর। এ রোগের বাহক হচ্ছে ক্ষুদ্র মশা। তবে বর্তমানে চিকিৎসাবিজ্ঞান এর প্রতিশোধক এবং প্রতিকার ব্যবস্থার অনেক উন্নতি সাধন করেছেন।
ডেঙ্গুজ্বর কী : মানবদেহে ডেঙ্গু ভাইরাসের আক্রান্ত জনিত ক্ল্যাসিক্যাল অথবা হেমোরেজিক তীব্র জ্বরের নামই হচ্ছে ডেঙ্গুজ্বর। অন্যকথায়,ডেঙ্গুজ্বর এক ধরনের জীবাণু বাহিত রোগ। মূলত ডেঙ্গুজ্বর হয় এডিস নামের এক ধরনের মশার কামড়ে। সাধারণত এই মশা দিনের বেলা কামড়ায়। মশার শুলের সাহায্যে এক ধরনের জীবাণু মানবদেহে খুব সহজে প্রবেশ করে। যার ফলে রোগী প্রথম দিন থেকেই ১০০°-১০৩° জ্বরে ভুগতে পারে বলে চিকিৎসকদের ধারণা, এ রোগের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। তবে ভয়ের তেমন কারণ নেই। এর প্রতিকার এবং প্রতিরোধ ব্যবস্থার ফলে অধিকাংশ রোগী সহজে অরোগ্য লাভ করতে পারে।
ডেঙ্গুজ্বরের ইতিহাস : ডেঙ্গুজ্বরের ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। বর্তমান যুগেই এর উৎপত্তি ঘটেছে। ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাসের Flaviviridad গোত্রভুক্ত। প্রায় ৭০ ধরনের ভাইরাসের মধ্যে আছে Yellow Fever সহ কয়েক রকমের ভাইরাস। ১৭৭৯-১৭৮০ সালে প্রাচীন বইগুলোতে প্রথম ডেঙ্গুজ্বরের মতো একটি রোগের তথ্য পাওয়া যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় প্রথম ডেঙ্গুজ্বরের সূত্রপাত ঘটে। এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করে প্রায় ১৮০০ সালের শেষের দিকে। এতে হাজার হাজার মানুষ সুচিকিৎসার অভাবে মৃত্যু ঘটে।
ডেঙ্গুজ্বরের শ্রেণীবিভাগ : চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রকাশ করেছে মূলত ডেঙ্গুজ্বর দুই প্রকার-
১.ডেঙ্গুজ্বর
২.হেমোরেজিক ডেঙ্গুজ্বর
ডেঙ্গু জ্বরের স্তর হলো চারটি। এগুলো হচ্ছে – DNA- 1,2,3,4। এগুলো সেরোটাইপ নামে পরিচিত। এই সেরোটাইপগুলো যেকোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার ক্ষমতা রাখে। ডেঙ্গুজ্বর উষ্ণমন্ডলীয় ও উপ-উষ্ণমণ্ডলীয় শহরাঞ্চলে স্থিতি লাভ করে। এজন্য শহরে ডেঙ্গুজ্বরের পরিমাণ বেশি দেখা যায়।
ডেঙ্গুজ্বরের বাহক : ডেঙ্গুজ্বর যা একটি মারাত্মক রোগ, আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্য এই রোগের বাহক হচ্ছে ক্ষুদ্র মশা। কিন্তু সব মশা নয়, এডিস নামক এক ধরনের বিশেষ মশা। এর কামড়ে মানবদেহে ভাইরাস প্রবেশ করে এবং তা খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যার ফলে রোগীর শরীরে তীব্র জ্বর অনুভূত হয়। অন্যান্য মশা চেয়ে এডিস মশার দৈহিক গঠনের পার্থক্য ভিন্ন। মূলত এর শরীরের রং গাঢ় কালো এবং নীল। সারা গায়ে সাদা কালো ও ডোরাকাটা দাগ থাকে। সামনের পায়ের তুলনায় পেছনের পাগুলো বেশ বড়। মূলত দুই ধরনের স্ত্রী মশা ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণু বহন করে।
এডিস মশার বংশবিস্তার : সাধারণত এডিস মশার বংশবিস্তার হয় নোংরা পরিবেশে এবং এখানেই এরা বেড়ে ওঠে। এদের প্রিয় স্থানগুলো হলো- অবব্যবহৃত ফুলের টপ, নারকেলের মালা,টায়ার,পুরনো টিনের কৌটা,ঝোপঝাড়, জঙ্গল,স্যাঁতসেঁতে জায়গা,পুকুরের পাড়সহ পানি জমে থাকা নোংরা স্থান। অন্যান্য মশার তুলনায় এডিস মশার পার্থক্য রয়েছে। কেননা এরা রাতের বেলার চেয়ে দিনের বেলা শিকারে বেড়াতে বেশি পছন্দ করে।
ডেঙ্গুজ্বরের কারণ : ডেঙ্গুজ্বর সাধারণ জ্বরের মতোই ভাইরাসজনিত একটি জ্বর। সাধারণত এডিস মশার কামড়ে এ জ্বর হয়ে থাকে। মানবদেহে এর ভাইরাস প্রবেশ করে। তবে টাইফয়েড অথবা সাধারণ জ্বরের সঙ্গে ডেঙ্গুজ্বরের পার্থক্য রয়েছে, কেননা ডেঙ্গুজ্বরের কামড়ে রোগী প্রথম দিন থেকেই তীব্র জ্বর অনুভব করে।
ডেঙ্গুজ্বরের প্রাথমিক লক্ষণ : প্রতিনিয়ত দেশে ডেঙ্গুজ্বরের সংখ্যা বাড়ছে এমনকি নিয়মিত নানা প্রান্ত থেকে ডেঙ্গুজ্বরের মৃত্যুর খবর আসছে। বিশেষ করে শিশুরা এ রোগে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। তাই এ বিষয়ে প্রত্যেককে সতর্ক থাকতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরের প্রাথমিক লক্ষণ হলো-জ্বর, মাথা ব্যথা,মাংসপেশীতে ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা,এবং রেস ওঠা। এছাড়া আরো ভালো করে বললে, ডেঙ্গুজ্বরের লক্ষণ হলো জ্বর, সাধারণত জ্বরের তাপমাত্রা প্রচন্ড তীব্র হয়ে থাকে যেটি প্রায় ১০৫° ফারেনহাইটের কাছাকাছি যেতে পারে। এর সঙ্গে দেখা দেয় বমি, মাথা ব্যথা এবং শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা। ডেঙ্গুজ্বর শরীরকে অনেক বেশি দুর্বল করে ফেলে। ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভারের কারণে অনেক সময় রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। যে কারণে ৪/৫ দিন পরে শরীরে রেস উঠে থাকে। এমনকি নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয় এবং দাঁত ব্রাশের সময়ও রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে। এছাড়া প্রসাব-পায়খানার সাথেও রক্ত যেতে পারে। তবে ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে একাধিক ওষুধ আবিষ্কার করেছেন।
ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা : ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হলে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। কেননা এটি সাধারণ ভাইরাস জ্বরের মত এবং চিকিৎসা একই রকম। এমনকি চিকিৎসা ছাড়াও জ্বর ভালো হতে পারে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে রোগীদের কোন প্রকার অ্যাক্রপিরিন অথবা জ্বর বা ব্যথার ওষুধ অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করানো যাবে না এবং মনে রাখতে হবে ডেঙ্গু জ্বরের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক সহায়ক নয়। জ্বর কমানোর জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোগীকে প্যারাসিটামল সেবন করানো যেতে পারে। এছাড়া বেশি বেশি তরল জাতীয় খাবার খাওয়াতে হবে। যেমন – পানি, স্যালাইন, তাজা ফলের রস, সুপ, দুধ ইত্যাদি। শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধ। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সতর্ক থাকলেই ডেঙ্গুজ্বর থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়।
ডেঙ্গু জ্বর ও এডিস মশা প্রতিরোধে করণীয় : আমরা পূর্বেই জেনেছি ডেঙ্গুজ্বরের বাহক হলো এডিস মশা। তাই এডিস মশা প্রতিরোধ করতে পারলে তবেই এ রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। ডেঙ্গু জ্বর ও এডিস মশা প্রতিরোধে করণীয় হলো –
১. বাড়ির আশপাশে বেশিদিন পানি জমতে না দেওয়া।
২. সর্বদা ড্রেন পরিষ্কার রাখা।
৩. মশার নিধরনের জন্য নিয়ম অনুযায়ী বিষক্রিয়া স্প্রে করা।
৪. বাড়ির আশপাশের ঝোপঝাড় সব সময় পরিষ্কার রাখা।
৫. ঘুমানোর পূর্বে মশারি ব্যবহার করা।
৬. এডিস মশা ধ্বংসের প্রতিকার ব্যবস্থা নেওয়া।
৭. পুকুরপাড় এবং নালার কিনারা পরিষ্কার রাখা।
বাংলাদেশের ডেঙ্গু জ্বরের কারণ ও প্রতিকার : ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গুজ্বর ধরা পড়ে। তারপর থেকে হাজার হাজার মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। ডেঙ্গুজ্বর মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিল। তবে বর্তমান আধুনিক চিকিৎসার কারণে এবং জনসচেতনতার ফলে অনেকাংশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রভাব কমে গেছে। কিন্তু এখনো ডেঙ্গুজ্বর সম্পূর্ণরূপে আশঙ্কামুক্ত নয়। তাই ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধে জনসচেতনতা ও এডিস মশা নিধরনের জন্য ফুলের টপ, ড্রেন, ঝোপঝাড়, নর্দমা, পুকুরের পাড়, ডোবা, বৃষ্টির পানি জমে না থাকার উপর বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে। ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্তদের নিয়মমত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। তবে ডেঙ্গুজ্বর নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।
উপসংহার : ডেঙ্গুজ্বর যা একটি ভাইরাস জনিত জ্বর এবং এর বাহক হচ্ছে এডিস মশা। মানবজীবনের জন্য এই ক্ষুদ্র মশা মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। তাই যতটা সম্ভব মশা নিধনসহ সচেতন ও আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তবেই মানুষ রোগমুক্ত থাকতে পারবে।
অন্যান্য রচনা
মোবাইল ফোন
যৌতুক প্রথা / পণপ্রথা
বাংলাদেশের কৃষক