digital bangladesh rochona

ডিজিটাল বাংলাদেশ

অথবা, দিন বদলের পালায় বাংলাদেশ  

ভূমিকা : বর্তমান নাগরিক সভ্যতার ক্রমোন্নয়নে বিজ্ঞানের গৌরবময় উপস্থিতি বিশ্ব সভ্যতাকে পৌঁছে দিয়েছে আবিষ্কারের শীর্ষ পর্যায়ে। বিজ্ঞান বিশ্ববাসীর কাছে তার অফুরন্ত ভান্ডার উন্মুক্ত করে দিয়ে বিশ্বের জাতিসমূহকে আহ্বান করছে তার স্বপ্নসুধা পান করে বিশ্বে পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হতে। আর এটিই যেন ধ্বনিত হয়েছে বিজ্ঞানী হলডেন  -এর কন্ঠে, “we need science more than ever before.” বিজ্ঞানের এই রহস্যময়ী আবেদনের সাড়া দিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পা বাড়িয়েছে বিজ্ঞানের ডিজিটাল সেপানে। স্বাধীনতার ৪৪ বছরের বেশি সময় অতিক্রম করেছে বাংলাদেশ, কিন্তু এর উন্নতি বলতে তেমন কিছু আজও দেখা যায়নি। তাই বর্তমান সরকার বাংলাদেশকে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ (Digital Bangladesh) হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। যার অর্থ হচ্ছে উন্নয়নের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে সনাতন পদ্ধতির স্থলে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতির প্রয়োগ, যার মাধ্যমে একদিন গড়ে উঠবে স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ। 

উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি নির্ভরতা : বিজ্ঞানের বা প্রযুক্তির ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বব্যাপী। হিংস্র পশুপাখি আর প্রকৃতির বিরূপ আচরণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য মানুষ যে প্রযুক্তির আশ্রয় নিয়েছিল তা আজ সমৃদ্ধি লাভ করেছে সর্বত্র। চীন, রাশিয়া, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ পৃথিবীর অনেক দেশ আজ প্রযুক্তিকে তাদের উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছে। এমনকি এর সহায়তায় বিশ্বে এটি আজ Super power -এর মর্যাদা লাভ করেছে। 

মানব জীবনে প্রযুক্তি : সভ্য জগতের মানুষ আজ সম্পূর্ণভাবে প্রযুক্তিনির্ভর। বৃহত্তর জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আছে প্রযুক্তির সক্রিয় ও প্রত্যক্ষ ভূমিকা। কৃষি, শিল্প, চিকিৎসা, শিক্ষা, বিনোদন  যেদিকে তাকানো যায় সেখানেই দেখা যায় প্রযুক্তির অধিপত্য। এ কথা এখন ধ্রুবতারার মতো সত্য যে, মানুষের জীবনে প্রযুক্তির বিকল্প এখন আর কিছু নেই। মানুষ প্রযুক্তি ছাড়তে চাইলেও প্রযুক্তি তাদেরকে ছাড়বে না। 

ডিজিটাল বাংলাদেশ কেমন হবে : বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরের মানুষের কাছে আলোচিত বিষয় হলো ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ।’ সবার মনে একটি কৌতুহল, কেমন হবে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ।’ ইংরেজি Digital শব্দের অর্থ হলো কম্পিউটার প্রযুক্তির সাথে সম্পর্ক স্থাপন বা সংযুক্ত হওয়া। মূলত ‘ডিজিটাল বাংলাদেশে’ -এর অর্থ হলো একটি আই.সি.টি (information and computing Technology) অর্থাৎ তথ্য ও কম্পিউটার ভিত্তিক প্রযুক্তি ; যার লক্ষ্য হলো প্রযুক্তিনির্ভর সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলাদেশের আধুনিকায়ন করা যেখানে অন লাইনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সংযুক্ত থাকবে বাংলাদেশের মানুষ। যেখানে এদেশের সকল সরকারি আধাসরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের কার্যসম্পাদন করবে। এটি হলো ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা। 

ডিজিটাল বাংলাদেশের উদ্দেশ্য : ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হলো সরকার, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি উৎপাদন, শিক্ষাসহ প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে উন্নতি সাধনের উপর জোর দেওয়া, যার মাধ্যমে একদিন বাস্তব রূপ লাভ করবে স্বপ্নের ডিজিটাল বাংলাদেশ। 

শিক্ষাক্ষেত্রে : শিক্ষা যেকোনো দেশের উন্নয়নে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশ করার লক্ষ্যে আমাদেরকে শিক্ষা ব্যবস্থাকে করতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক সহ শিক্ষাব্যবস্থার সকল স্তরে ডিজিটাল ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান পদ্ধতি চালু করা এবং সারা দেশব্যাপী ইন্টারনেট সংযোগ বিস্তৃত করতে হবে। 

কৃষিক্ষেত্রে : কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বাংলাদেশে কৃষিকে বাদ দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা কখনোই সফল হবে না। আর তাই স্বপ্নের লক্ষ্য বাস্তবায়নে কৃষিকে করে তুলতে হবে প্রযুক্তিনির্ভর। জমি কর্ষণ থেকে শুরু করে শস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে প্রযুক্তিকে সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে ৬ গুণ বেশি উৎপাদন সম্ভব। এজন্য কৃষির প্রাণভূমি বাংলাদেশকে ডিজিটাল করে এক ধাপ এগিয়ে নেওয়ার জন্য কৃষিতে আনতে হবে প্রযুক্তির ছোঁয়া। 

চিকিৎসা ক্ষেত্রে : রোগ নিরাময়ের প্রথম শর্ত হলো নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় করা। রোগ নির্ণয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা দুর্গম স্থানে থাকা মুমূর্ষু রোগীর চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

বিনোদনের ক্ষেত্রে : বিনোদনের ক্ষেত্রে বর্তমান যুগের ছেলেমেয়েদের কাছে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক একমাত্র জনপ্রিয় মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূর দেশের কারও সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন, খেলাধুলা ইত্যাদি এখন মাউসের ‘ক্লিক’ শব্দ মাত্র। স্বপ্নের বাংলাদেশের প্রতিটি স্থানেই হয়তো একদিন বসবে বিনোদনের মিলনমেলা। 

যোগাযোগ ক্ষেত্রে : বর্তমান বিশ্বকে Global village হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর ইন্টারনেট, অনলাইন, ফোন, ফ্যাক্স প্রভৃতির মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে খুব সহজে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। সমগ্র দেশকে একটি ডিজিটাল কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারলে প্রতিটি মানুষ বিশ্ব তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়কে তার জ্ঞানের চাকাকে সচল করতে সমর্থ্য হবে। যা দেশের সার্বিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।  

অফিস আদালতে : প্রশাসনিক গতিময়তা আনয়নের  লক্ষ্যে সর্বপ্রথম যে কাজটি করা একান্ত প্রয়োজন তাহলো অফিস আদালতে কম্পিউটার প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার। এক্ষেত্রে সি সি ক্যামেরা অফিস-আদালতের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি দূর করে কর্মে গতি ফিরে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এছাড়াও ইন্টারনেটের মাধ্যমে অফিস আদালতের একঘেয়েমি কাজেও আসতে পারে স্বাচ্ছন্দ্য, যা কাজের গতিকে ত্বরান্বিত করে। 

নিরাপত্তা বিধানে : বর্তমান জীবনের সকল ক্ষেত্রেই নিরাপত্তার বিষয়টি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত। ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে পারলে জাতির উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত হয়। কারণ নিরাপত্তা হীনতায় কোনো জাতিই দেশের সুষম উন্নয়ন আনতে পারে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উন্নয়নের ডিজিটাল বাংলাদেশের কম্পিউটার প্রযুক্তি রাখতে পারবে অগ্রণী ভূমিকা। 

প্রকাশনার ক্ষেত্রে : কম্পিউটার প্রযুক্তি অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রকাশনা জগতে কম্পিউটার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। নির্ভুল তথ্য এবং সঠিক বানান নির্ণয়ে কম্পিউটার প্রযুক্তি সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। 

সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে : ইন্টারনেটের সাহায্যে বর্তমানে একটি পত্রিকা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রকাশিত হচ্ছে। ফলে এখন পত্রিকা মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে অতি সহজে। তাছাড়া ওয়েব সাইটের মাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদও আমরা ঘরে বসেই পেয়ে যাচ্ছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলে হয়তো আমরা ডিজিটাল পত্রিকাও পেয়ে যাবো হাতের কাছে। 

শেয়ার বাজারের ক্ষেত্রে : শেয়ার বাজারের লেনদেন এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে পণ্যের ক্রয়-বিক্রয়ের হিসাব রাখতে এখন ব্যবহৃত হচ্ছে কম্পিউটার প্রযুক্তি। অনলাইনের মাধ্যমে এখন ঘরে বসেও লেনদেনের বিষয়টি অতি সহজেই করে নেওয়া যাচ্ছে। যা ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। 

অনলাইন তথ্যকেন্দ্র স্থাপন : গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বিভিন্ন তথ্য ও সেবা প্রতিষ্ঠা মানুষের জানার এবং পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আর এটি সম্ভব একমাত্র অনলাইন তথ্য সেবা কেন্দ্র স্থাপন। যার মাধ্যমে প্রতিটি মানুষ সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ ও সেবা গ্রহণ করতে পারবে। যা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার জন্য একান্ত আবশ্যক এবং প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। 

একটি অশনি সংকেত : বলতে অনেক কষ্ট লাগে এই ভেবে যে আমরা বাঙালি জাতি। যে জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বীরের বেশে অর্জন করেছিল স্বাধীনতা, সেই জাতি আজ অলসতার দায়ে অভিযুক্ত। আরামপ্রিয় বাঙালি সমাজ আজ কর্মবিমুখ। সেই জাতি আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নে অগ্রসর হচ্ছে। আর সেই সাথে একটি আশঙ্কা জাগ্রত হচ্ছে যে, এটি আমাদেরকে করবে আরও অলস, শুধু আমাদের প্রেক্ষিতে নয়, সারা বিশ্বের প্রযুক্তি নির্ভরশীল দেশ সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের অভিমত। মানুষের সৃষ্ট প্রযুক্তি দিয়ে কাজ করাতে করাতে এমন এক সময় আসবে, যখন কাজের ক্ষুধায় উন্মত্ত দানব তার স্রষ্টা মানুষকে ক্রীতদাস। কথাটাকে একটু ঘুরিয়ে দেখলেই দেখা যাবে বাস্তব সত্যটা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষিতেও সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ডিজিটাল প্রযুক্তি মানুষের কাজ কেড়ে নিলে বেকারের মিছিলে ভরে যাবে দেশ। অন্যদিকে এক শ্রেণীর আরামপ্রিয় মানুষ হয়ে পড়বে গৃহবন্দি। ডিজিটাল শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষার্থীরা বই পড়ার অভ্যাস ত্যাগ করবে, ফলে জাতি প্রকৃত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়বে। তবে এটি নির্ভর করবে ডিজিটাল বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনার ওপরে যা খারাপ ভালো দু দিকই বয়ে আনতে পারে। 

তবুও আশার আলো : পূর্ব সংকেত পড়ার পর মনে হতে পারে ‘তাহলে কি ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে!’ অবশ্যই না, আলো-আঁধারের মতো সর্বক্ষেত্রের সুবিধা-অসুবিধা থাকবেই। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ কার্য ব্যবস্থাপনাও যদি ডিজিটালভাবে এবং প্রযুক্তি ও মানুষের সমন্বয়ে করা যায় তাহলে ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদেরকে একটি সমৃদ্ধশালী দেশ গঠনে সহায়তা করবে। কর্মক্ষেত্রে যদি মানুষ কর্মের সুযোগ পায় তবে তারা কাজে যেমন আনন্দ পাবে তেমনি তারা হয়ে উঠবে একেক জন দক্ষকর্মী। তাই শত অন্ধকারের মধ্যেও আমরা আশার আলো দেখি ডিজিটাল বাংলাদেশে মানুষের স্বচ্ছন্দ বিচরণ।

উপসংহার : বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল দেশ। এদেশের প্রযুক্তিগত উন্নয়ন বলতে যা হয়েছে তা অতি ক্ষুদ্র। এখন প্রযুক্তি বিদ্যার বিজয় সারা বিশ্বে ঘোষিত হচ্ছে মহাসমারোহে, তারই অংশ হিসেবে বর্তমান সরকার, বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্য মাত্র হাতে নিয়েছে। বাংলাদেশও প্রযুক্তির ব্যবহারের উন্নয়ন সাধন করা কঠিন কিছু নয়। এরই জন্য শুধু প্রয়োজন সঠিক দিক নির্দেশনা ও কর্মতৎপরতা আর সাধারণ মানুষের সহযোগিতার হাত। তবে একদিন বাস্তবায়ন হবে স্বপ্নের এক দেশ বা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ।’ 

Digital Bangladesh Rochona PDF
ডিজিটাল বাংলাদেশ রচনা PDF

 

অন্যান্য রচনা
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও তার প্রতিকার
কৃষি কাজে বিজ্ঞান
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ