Durniti rochona

সমাজ জীবনে দুর্নীতি

অথবা, দুর্নীতি ও তার প্রতিকার 

ভূমিকা : পৃথিবীতে দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। দেশটি অর্থনৈতিকভাবে এখনো মজবুত বৃত্তির উপর দাঁড়াতে পারেনি। সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন সমস্যা মোকাবেলা করেই দেশকে প্রতিনিয়ত এগোতে হচ্ছে। কিন্তু সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সব থেকে বড় বাঁধা হচ্ছে দুর্নীতি। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি বিদ্যমান, সেটা নিম্নস্তরের কেরানী থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত বিদ্যমান। এই অবস্থার কারণে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটেছে। এই পরিস্থিতির কোন উন্নতি না হলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হয়ে পড়বে অনিশ্চিত ও অনুজ্জ্বল। এই দেশকে যদি আমরা একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই, তাহলে দুর্নীতি দমনে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। ব্যক্তি মানুষও সেই সম্পর্কে যেন সচেতন হয়, এজন্য দুর্নীতির কুফল প্রচার করতে হবে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি সচেতন প্রত্যেক মানুষকে দুর্নীতি দমনে এগিয়ে আসতে হবে। 

দুর্নীতি কী : দুর্নীতির আভিধানিক অর্থ হলো নীতিবিরুদ্ধ, কুনীতি, অসদাচরণ। ঘুষ বা অনুগ্রহ দ্বারা জনকর্তব্য সম্পাদনে একাগ্রতার বিকৃতি বা ধ্বংসই হলো দুর্নীতি। অন্যভাবে বলা যেতে পারে,নীতিবিচ্যুত হওয়া বা কোনো গুণ ও পবিত্রতার অবমাননাই হলো দুর্নীতি। 

দুর্নীতির ইংরেজি শব্দ হলো ‘Corruption’। এটি ল্যাটিন ‘Corruptus’ থেকে এসেছে, যার অর্থ ধ্বংস বা ক্ষতিসাধন। অন্যকথায়, সরকারি প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে আমরা বুঝি অফিস আদালতকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য অপব্যবহার করা। 

বাংলাদেশের দুর্নীতির বিস্তার : স্বাধীন এই বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের অনেক গৌরব আছে। কিন্তু বারবার দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে যে কলঙ্ক বাংলাদেশ কুড়িয়েছে তা আমাদের গর্ব অনেকটা খর্ব করেছে। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাব্যবস্থা, সংস্কৃতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তীকালে জনগণ যেখানে চেয়েছিলেন একটি সুন্দর সমাজ ও পরিচ্ছন্ন আর্থসামাজিক পরিবেশ, কিন্তু আজ তা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। কেননা, বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতি প্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম অবস্থানে রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে পরপর তিন বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকে বাংলাদেশ ছিল সবার প্রথমে। দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার এই কলঙ্ক গোছানোর উদ্যোগ নেওয়া হলেও দেশে এখনও আশানুরূপ পরিবর্তন আসেনি। কেননা সমাজজীবনে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে। নিম্নে বাংলাদেশের যেসব ক্ষেত্রে দুর্নীতির বিস্তার ঘটেছে তার চিত্র তুলে ধরা হলো :

জনকল্যাণমূলক খাতে দুর্নীতি : বাংলাদেশে যেসব জনকল্যাণমূলক খাত রয়েছে, সেগুলোতে দুর্নীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এ দুর্নীতির কারণে জনসংখ্যা দারুনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেক সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জনকল্যাণের নামে লোক দেখানো কর্মসূচি পালন করে। এমনকি গোপনে তারা বরাদ্দকৃত অর্থের সিংহভাগই আত্মসাৎ করে।  আবার যোগ্য ব্যক্তির পরিবর্তে স্বজনপ্রীতির কারণে ও জনসংখ্যা মূলক কাজের অযোগ্য ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ফলে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে। 

আইন শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীতে দুর্নীতি : বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, পুলিশ জনগণের বন্ধু। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় তার উল্টো। একটা সত্যি মামলা নিয়ে থানায় গেলে পুলিশ অনেক সময় সাহায্য না করে বরং অপরাধীদের মুক্ত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। প্রশাসনের প্রশ্রয়ে অপরাধীরা খালাস পেয়ে যায়। দুর্নীতির কারণেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সত্যিকার দায়িত্ব পালন করে না। ফলে সমাজে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়। দেশের সর্বত্র মাদকব্যবসা, সন্ত্রাস,পর্নোগ্রাফির ব্যবসা, ধর্ষণ, খুন, চাঁদাবাজির পেছনে সম্পৃক্ততা থাকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। তাদের দুর্নীতির কারণেই সমাজ থেকে এগুলো নির্মূল করা কঠিন হয়ে পড়েছে। 

শিক্ষাক্ষেত্রে দুর্নীতি : শিক্ষাব্যবস্থাকে বাজারমুখী করার ফলে শিক্ষার উদ্দেশ্য হয়ে পড়েছে শুধু সার্টিফিকেট অর্জন করা। তাই যেকোনো প্রকার ভালো রেজাল্ট করার দিকেই সবার ঝোঁক। এজন্য বেড়ে চলেছে নকল প্রবণতা ও প্রশ্ন ফাঁসের মতো দুর্নীতি। অসৎ ব্যবসায়ী ও অসৎ শিক্ষকদের কারণে শিক্ষাক্ষেত্রে এ ধরনের দুর্নীতি দিন দিন মারাত্মক রূপ নিচ্ছে। ফলে শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরাজ করছে নৈরাজ্য। প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসি ইত্যাদি বোর্ড পরীক্ষা সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি পরীক্ষায় যেভাবে প্রশ্ন ফাঁস ও দুর্নীতি হয়েছে, তা দেশের জন্য অত্যন্ত লজ্জা কর। 

সরকারি সেবা সংস্থায় দুর্নীতি : দেশের সেবা সমূহ যেমন : গ্যাস টেলিফোন বিদ্যুৎ ইত্যাদি লাইন পেতে গেলে বর্তমানে ঘুষ বা উৎকোচ ছাড়া সম্ভব হয় না। অনেক ধনী ব্যক্তি আছে যারা অসৎভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ, গ্যাস বা টেলিফোন সংযোগ ব্যবহার করেও বিল পরিশোধ করে না। দায়িত্বরত কর্মকর্তাকে ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে তারা রেহাই পেয়ে যায়। এ কারণে জাতীয় সম্পদের অপচয় বাড়তে থাকে। 

রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি : বর্তমানে দেশে রাজনৈতিক পটভূমিতে যে সংস্কৃতি বিদ্যমান তার মধ্যে দুর্নীতি হলো একটি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নির্বাচনে কারচুপি, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে সংসদে যাওয়া যেন রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ষমতা পাওয়ার পর প্রতিশ্রুতি না রাখা, ক্ষমতার অসৎ ব্যবহার করে অর্থ উপার্জন, সরকারি অনুদান আত্মসাৎ ইত্যাদি বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির চালচিত্র। 

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি : সিন্ডিকেট গঠনের মাধ্যমে দ্রব্য বাজারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায় বিভিন্ন অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, চোরাকারবার, খাদ্যে ভেজাল দেওয়া, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, সরকারি রেশনে কারচুপি করা, খাজনা ইত্যাদি ফাঁকি দেয়াসহ বহু দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকে ধ্বংসের মুখে ফেলছে। সাম্প্রতি দেশে ব্যাংক ডাকাতি, শেয়ারবাজার দুর্নীতি, প্রভৃতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধে করণীয় : দুর্নীতি কখনোই সমাজের জন্য সুখময় নয়। এটি সমাজে পচন ধরিয়ে ক্রমাগত সমাজ জীবনকে কলুষিত করছে। তাই এই দুর্নীতি নামক অভিশাপকে সমাজ জীবন থেকে বিলুপ্ত করা জরুরী হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশ হতে পারত যদি দুর্নীতি দূর করা যেত। বাংলাদেশে দুর্নীতি প্রতিরোধে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গুলো গ্রহণ করা যেতে পারে —

১. নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সঞ্চার : দুর্নীতি দূর করতে প্রথমেই দরকার সমাজের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সঞ্চার করা। শিক্ষা ব্যবস্থায় দুর্নীতির ভয়াবহতা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতা গড়ে তোলার আয়োজন রাখতে হবে। দুর্নীতির প্রতি মানুষের মনে তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করতে হবে।
২. আইন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : দুর্নীতির মত ভয়াবহ একটি অপরাধ দমন করতে আইনের শাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে ভয়ে অন্যরা দুর্নীতিবাজরা পথ থেকে সরে আসবে।
৩. দুদক শক্তিশালী করা : দুর্নীতি দমনের জন্য বাংলাদেশের যে ‘দুর্নীতি দমন কমিশন’ রয়েছে তাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ ছাড়াই দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কার্য পরিচালনার সুযোগ দিতে হবে।
৪. সামাজিক আন্দোলন : দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
৫. বয়কট : দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানকে সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। রাষ্ট্রীয় বা সরকারিভাবে সেসব প্রতিষ্ঠানের উপর নিষেধাজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।
৬. রাজনৈতিক বোধের উন্নয়ন : দেশের উন্নয়নে মূলে রয়েছে রাজনীতি। আর রাজনৈতিক শক্তির মূলে রয়েছে জনগণের মতামত। এজন্য জনগণের কল্যাণেই যেন রাজনৈতিক পরিচালিত হয়। যারা দেশের প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িয়ে আছে, তাদের এই বোধের সঞ্চার হতে হবে।
৭. জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহ কার্যকর করা : দেশের দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য সকল সরকারি বা জাতীয় প্রতিষ্ঠান সমূহে যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিকে দায়িত্বে রেখে কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে হবে। প্রত্যেক জাতীয় প্রতিষ্ঠানে এভাবে কার্যকর করতে হবে।
৮. টাস্কফোর্স গঠন : বাংলাদেশের সকল স্থানের দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে একটি দুর্নীতি বিরোধী টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। এই টাস্কফোর্স দুর্নীতি একেবারে দূর করার জন্য একটি বিশদ কর্মসূচি সুপারিশ করবে। সেই সুপারিশ অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করতে হবে। 

উপরোক্ত পদক্ষেপ ছাড়াও দুর্নীতি দমনে আমাদেরকে আইন সংস্কারে, বেকারত্ব হ্রাসে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির প্রতি নজর দিতে হবে। তবেই দুর্নীতি দূরীকরণ আরো সহজ হবে। 

উপসংহার : দুর্নীতি সমাজের উন্নয়নের অন্তরায়। সমাজ জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে সংক্রামক ব্যাধির মতোই এর বিস্তার ঘটছে। আর পচন ধরেছে পুরো সমাজে। এজন্য সমাজজীবন থেকে দুর্নীতি দূর করতে না পারলে কখনোই মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব নয়। বাংলাদেশকে দুর্নীতি মুক্ত করতে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সংস্থা এবং সমাজের সচেতন প্রতিটি ব্যক্তিকেই এগিয়ে আসতে হবে তবেই গড়ে তোলা যাবে দুর্নীতিমুক্ত একটি মানবিক ও শান্তির সমাজ।

সমাজ জীবনে দুর্নীতি PDF Format

অন্যান্য রচনা
বাংলাদেশের ষড়ঋতু
জনসংখ্যা সমস্যা
ছাত্র জীবন

Facebook
Pinterest
Reddit