ভূমিকা : যেকোনো জাতির কাছে প্রিয় ভাষা হলো তার মাতৃভাষা। মানুষের জীবনে মাতৃভাষার গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলার মানুষ তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছিল মাতৃভাষা। এজন্য বিশ্ব এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এখানেই একুশ ও মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য।
“আবার ফুটেছে দেখো কৃষ্ণচূড়া/ থরে থরে শহরের পথে
কেবল নিবিড় হয়ে কখনোওবা / একা হেঁটে যেতে মনে হয় ফুল নয় ওরা,
শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ/ স্মৃতি গন্ধে ভরপুর
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনারই রক্ত।”
— শামসুর রাহমান
মানুষ যেদিন বেরিয়ে এলো পাহাড়ের আদিম সেই গুহা থেকে, দেখল নতুন পৃথিবী – নিজেদেরকে বিভিন্নভাবে আবিষ্কার করল। সেদিন উপলব্ধি করতে পারেনি তারাও এ জগতে শিল্পের উন্মেষ ঘটাবে। আর জীবনের প্রয়োজনের জন্য তারা গুহাতে এঁকেছিল শিকারের একাধিক কৌশল। এক সময় এই মানুষই জীবনযাত্রাকে আরো সহজসাধ্য করার তাগিদ অনুভব করল। তারা কল্পনা করল এক আনাবিষ্কৃত সারল্য। সেই কল্পনা বাস্তবে রূপ নিল। তারপর আবিষ্কৃত হলো লেখার হরফ। পরিবেশে সৃষ্টি হলো ভাষা।
একুশের স্বরূপ : একটি ভাষা থেকে উৎপত্তি হলো বাঙালি জাতির। যে জাতির রয়েছে হাজার বছরের বীরত্বগাথা ইতিহাস। যে জাতির পরিচয় বীরের জাতি হিসেবে। মহান একুশে এ জাতির অন্যতম সৃষ্টি। একুশ হলো – একটি চেতনা ও একটি বৈশ্বিক প্রতীক। একুশ এখন পৃথিবীর প্রায় সাড়ে তিন হাজারের ওপর ভাষার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। একুশ বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ও বিভিন্ন জাতীয় ভাষা গোষ্ঠীর হিরন্ময় প্রতীক।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ব্রিটিশ সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রস্তাব নিয়ে ভারতে আসে ক্যাবিনেট মিশন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনেক আগে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন এবং বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেন। এভাবেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব থেকেই রাষ্ট্রভাষার বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি : ভাষার অধিকারের জন্য জনগণের এ অতুলনীয় সংগ্রাম হঠাৎ এসে হাজির হয়নি। এর সংক্ষিপ্ত চিত্র নিম্নরূপ :–
★ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসের দিকে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রথম বক্তব্য দিয়েছিলেন।
★ ১৯৪৮ সালের ২৩ শে ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের আইনবিধি সংক্রান্ত বৈঠকে ইংরেজি ভাষার সাথে উর্দু ভাষার নাম যুক্ত করার চেষ্টা হলে বাঙালি সংসদ সদস্য শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার সাথে বাংলা সংযুক্তির দাবি জানালে পাকিস্তানে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখাযায়।
★১৯৪৮ সালে গণপরিষদে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা দিলে গণপরিষদের বাঙালি সদস্যরা এই ঘোষণা মেনে নেয়নি। কিন্তু ২১ শে মার্চ ১৯৪৮ সালে এক জনসেবায় মোঃ আলী জিন্নাহর ঘোষণা দেয় উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। এই ঘোষণা বাংলার বীর সন্তানেরা মেনে নেয়নি ফলে প্রতিবাদ আন্দোলন গড়েওঠে।
★ ১৯৫২ সালে ২৬ শে জানুয়ারি গভর্নর জেনারেলের মদদপুষ্ট হয়ে মুসলিম লীগের এর জনসভায় প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন পুনরায় বলেন “উর্দু, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।” শুরু হয় চূড়ান্ত ভাষা বিদ্রোহ।
★ ১৯৫২ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এর মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ছাত্র জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে গুলি চালায়। ফলে নিহত হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার সহ আরো অনেকে। অবশেষে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায়।
★ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের বীজ অঙ্কুরিত হয়। যার ফলশ্রুতিতে বাঙালি পায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য : আমাদের জাতীয় জীবনে আন্দোলন মুখর এই দিনটির তাৎপর্য অনেক গভীর। বুকের রক্ত ঝরা ওই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়েছে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকার। তা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে দুর্বার প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। একুশে ফেব্রুয়ারি সংগ্রামের পথ ধরেই আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামে শামিল হয়েছিলাম এবং অর্জন করেছি মুক্তিযুদ্ধের বিজয়।
বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা : অনেক আগে থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি অবহেলা চলে আসছে। দেশের বৃহত্তর জনসংখ্যার মাতৃভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বাংলাকে অবহেলা করে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু বাংলার মানুষ এই ঘোষণা মেনে নিতে পারেনি। তাদের স্বেচ্ছার প্রতিবাদী কন্ঠে সারা বাংলা জেগে ওঠে।
বাংলা ভাষার আন্দোলন : মূলত বাংলা ভাষার আন্দোলন ১৯৪৮ সাল থেকেই শুরু হয়। আস্তে আস্তে এই আন্দোলন সারা বাংলাদেশ এবং পূর্ব পাকিস্তানের ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটালেও ক্রমাগত সমস্ত জনগণ এই আন্দোলনে জড়িত হয় এবং আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। সরকার ভাষা আন্দোলনের উপর দমনন নীতি চালায়, কিন্তু এই আন্দোলন আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
একুশে ফেব্রুয়ারি : ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনকে কেন্দ্র করে সারাদেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ধর্মঘট ডাকা হয়। ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করে সভা-সমিতি ও মিছিল নিষিদ্ধ করে স্বৈরাচারী সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাজপথে মিছিল বের করে। তারা সরকারের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাই। কিন্তু স্বৈরাচারী সরকার তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য মেডিকেল কলেজের সামনে মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। যার ফলে সালাম বরকত রফিক শফিক বরকত জব্বার সহ আরো অনেক ছাত্র প্রাণ হারায়, যা পরবর্তীকালে বাঙালির নবজাগরণকে আরো কার্যকর করে।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি প্রদান : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির জঘন্য হত্যাকাণ্ডের খবর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এ খবরে সারা দেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এ কারণে ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানি সরকার সংবিধানে বাংলাকে স্বীকৃতি দেয়।
শহীদ দিবস : ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি স্মরণ করার জন্য প্রতিবছর শহীদ দিবস পালন করা হয়। কিন্তু শহীদ দিবস পালনের মধ্যেই একুশে ফেব্রুয়ারির তাৎপর্য সীমাবদ্ধ থাকে না। বাঙালির জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে।
একুশের প্রভাব : বাঙালি জাতির জীবনের সকল ক্ষেত্রেই একুশের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। আমরা একুশের ঘটনা থেকে যে চেতনা অর্জন করেছি, তা পরবর্তীতে সকল আন্দোলনের প্রেরণা হিসেবে কাজ করবে। একুশের পর থেকে তাদের ভেতরে দেশপ্রেমের উন্মেষ ঘটেছে। একুশের চেতনা থেকে বাঙালি জাতি অত্যাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার শক্তি লাভ করেছে।
বর্তমান একুশ : বাংলার মানুষ ভাষাশহীদদের স্মরণে প্রতিবছর ভাবগম্ভীর পরিবেশের মধ্য দিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করেন। বর্তমানে দেশে প্রচুর পরিমাণে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। আগের থেকে মানুষ এখন একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে অনেকটা সচেতন হয়েছে। এমনকি একুশ নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা আয়োজন করা হয়।
একুশের চেতনা : একুশের মধ্য দিয়েই আমরা আপন সত্তা আবিষ্কার করতে পেরেছি। এমনকি এর মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছি স্বাধিকার অর্জনের প্রেরণা। কিন্তু এই প্রেরণা ও চেতনাকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সাম্প্রদায়িক শাসকগোষ্ঠী ষড়যন্ত্র করতে থাকে। যার ফলে অনেক শহীদ মিনার ভেঙে ফেলা হয়েছে। এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরেও এই একুশের প্রেরণাকে ও চেতনাকে ধ্বংস করতে পারেনি। কেননা বাঙালি জাতির মনে এই চেতনা গেঁথে রয়েছে।
একুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও তাৎপর্য : ১৯৯৯ সালের ১৭ই নভেম্বর ইউনেস্কো একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। এ ঘোষণা বাংলার মানুষের জন্য বিশাল এক পাওয়া। মূলত এই ঘোষনার জন্য বিশ্বের প্রায় ৪ হাজারের বেশি ভাষাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার ফলে আমাদের ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগের আন্তরিক স্বীকৃতি মিলেছে।
মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা : ২০০০ সাল থেকে ইউনেস্কো বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য সদস্য দেশগুলোর কাছে তারিখ নির্ণয়ের সুপারিশ চাওয়া হয়। বাংলাদেশও দিবসটি পালনের জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি গৌরবগাথা বা তাৎপর্য তুলে ধরে। বাঙালি মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে, রক্ত দিয়েছে, তাই ইউনেস্কো এই আত্মত্যাগের বিষয়টিকে সম্মান জানিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘোষণা করায় বাঙালির আনন্দ উৎসব : একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পরে বাঙালি আনন্দে উৎসবে মেতে ওঠে। তাই ১৯৯৯ সালের ৭ ই ডিসেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় উৎসবের আয়োজন করে।
উপসংহার : একুশ বাঙালির জাতীয় চেতনার উৎসমূল। ভাষা আন্দোলনের বীজ অঙ্কুরিত হয়েই বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম। এই আন্দোলন ন্যায্য অধিকারের দাবি। স্বায়ত্তশাসনের এ দাবি থেকেই অঙ্কুরিত হয়েছে আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রামের সাফল্য থেকেই বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
একুশে ফেব্রুয়ারি অথবা, জাতীয় জীবনে একুশের চেতনা PDF Format
অন্যান্য রচনা
প্রতিবন্ধীদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
একটি গাছ একটি প্রাণ
কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪