joutuk protha rochona

যৌতুক প্রথা / পণপ্রথা 

ভূমিকা : যৌতুক প্রথা যা একটি সামাজিক ব্যাধি। যৌতুকের কারণে পারিবারিক অশান্তি, মানসিক বিকারগ্রস্ততা, দাম্পত্য কলহ, এগুলো সৃষ্টি হয়। এই যৌতুক প্রথার কারণে হাজারো নারীরা তার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এমনকি অধিকাংশ নারীর জীবন অকালে ঝরে পড়েছে যৌতুক প্রথার পদতলে পিষ্ট হয়ে। অভিশপ্ত যৌতুক প্রথায় ভেঙে গেছে হাজারো সুখের সংসার। দাম্পত্য জীবনে যৌতুক প্রথার কারণে নানা কলহলের সূত্রপাত হয়ে থাকে। যৌতুক গ্রহণ হয়তো ক্ষণেকের জন্য অর্থনৈতিক সুবিধা দেয়। কিন্তু তা সারা জীবনের একটি কলঙ্কিত অধ্যায় বলে বিবেচিত হয়।  

যৌতুক প্রথা কী : বিবাহের পূর্বে বা পরে অথবা বিবাহের সময় দ্রব্যসামগ্রী কিংবা আর্থিক লেনদেনের জন্য বর ও কনের পক্ষের মধ্য চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়াকে যৌতুক প্রথা বলে। দীর্ঘদিন যাবত চুক্তি পরম্পরায় বলবৎ রাখাকে যৌতুক প্রথা বলতে বোঝায়। বলা যেতে পারে এটি একটি অভিশপ্ত প্রথা। 

যৌতুক প্রথার ইতিহাস : কিভাবে বা কখন, কবে, কোথায় যৌতুকের সূচনা হয়েছিল তা সঠিকভাবে বলা অসম্ভব। তবে ধারণা করা হয় যে হিন্দুসমাজ থেকে এই অভিশপ্ত প্রথার সূচনা হয়েছিল। হিন্দু সমাজের আইন অনুযায়ী পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ মেয়েরা পায় না। তাই হিন্দু কনে বিবাহের সময় সামর্থ্য অনুযায়ী দ্রব্যসামগ্রী এবং অর্থ দিয়ে বরের হাতে কনেকে তুলে দিতেন। যা পরবর্তী সময়ে সমাজে যৌতুক প্রথায় পরিণত হয়। 

যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি : যৌতুক প্রথা একটি সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার পরিবার। যৌতুকের কম বা বেশি পরিমাণের ওপর নির্ভর করে স্বামী-স্ত্রী দাম্পত্য জীবন । তাই বলা যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘দেনাপাওনা’ ছোট্টগল্পের উক্তিটি – “বাপ যদি পুরা দাম দিত মেয়ে পুরা যত্ন পাইতো।” যৌতুকের কারণে এই গল্পের নিরুপমাকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এভাবে সমাজে যৌতুকের কারণে হাজারো নারীকে জীবন দিতে হয়েছে। তাই সমাজের এই মারাত্মক ব্যাধি উত্তরণের  জন্য আমাদের সবারই চেষ্টা করা উচিত। 

যৌতুকের কারণে নারীর মর্যাদা হ্রাস পায় : এই অভিশপ্ত যৌতুকের কারণে হাজার হাজার নারীর মর্যাদা বহু গুণে হ্রাস পাচ্ছে। যৌতুকের কারণে নারীরা শ্বশুরবাড়িতে অবহেলা এবং নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। শশুরবাড়ি থেকে যে যত পরিমাণে যৌতুক নিতে পারে তার মর্যাদা এবং সম্মান তত বেশি বলে মনে করা হয়। এজন্য বলা যেতে পারে,যৌতুকের কারণে নারীদের মর্যাদা হ্রাস পাই। 

যৌতুক দাম্পত্য জীবনে অশান্তি ঘটায় : সামাজিক জীবনে অশান্তির মূল কারণ হচ্ছে যৌতুক। বর ও কনে উভয়ের সম্মতিতে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। কিন্তু বিবাহ সম্পূর্ণ হওয়ার পরে যৌতুকের লেনদেনের কারনে বিরোধের সৃষ্টি ঘটে। কনের বাবা যেমন যৌতুক প্রদান করতে চেয়েছিলেন, তা যদি ঠিকঠাক মতো না দেওয়া হয় তাহলে যৌতুকের অভিশপ্ত রূপ চোখে পড়ে। বরের পরিবার যৌতুকের জন্য কনের পরিবারকে নানাভাবে চাপ দিতে থাকে। যেখান থেকে শুরু হয় সংসারে নানা ধরনের অশান্তি। এক পর্যায়ে দাম্পত্য জীবন বিবাহ বিচ্ছেদে পরিণত হয়।

যৌতুকের কারণে পুরুষের লজ্জা হ্রাস পায় : যৌতুকের কারণে পুরুষের লজ্জা হাজার গুনে হ্রাস পায়। সাধারণত লোভী মানুষেরা এই পথে পা বাড়ায়। তারা কোনোভাবেই লোভকে সংবরণ করতে পারে না। যৌতুক গ্রহণকারী ব্যক্তি হয় পশুর থেকেও নিম্ন। শ্বশুরবাড়ি থেকে আতিথ্য গ্রহণের আশায় সে কনের পরিবারের সাথে অশালীন আচরণ করতেও দ্বিধা করে না। শুধু তা-ই নয় যৌতুক আদায়ের জন্য এরা মানুষকে খুন করতে বিন্দুমাত্র কষ্ট অনুভব করে না।

যৌতুকের কারণে স্বামীর প্রতি স্ত্রীর অবাধ্যতা : যৌতুকের কারণে স্ত্রী স্বামীকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। স্বামীর কোন কথাই শুনতে চায় না। এতে একে অপরকে বোঝাপড়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে উভয়ের মধ্য তৈরি হয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও নানা ধরনের অশান্তি সর্বক্ষণ লেগেই থাকে। যার ফলে তাদের মধ্য কখনো ভালোবাসা তৈরি হয় না। স্বামী-স্ত্রীকে কোন বিষয়ে কিছু বোঝাতে গেলে সে সঠিকভাবে তা শুনতে চায় না।  এমনকি শশুর,শাশুড়িকে সে মূল্যায়ন করে না। সর্বোপরি, যৌতুক গ্রহণের কারণেই স্ত্রীর মধ্যে অবাধ্যতা তৈরি হয়। 

যৌতুকের কারণে নারী নির্যাতন বৃদ্ধি পায় : নারী নির্যাতনের মূল কারণ হচ্ছে এই অভিশপ্ত যৌতুক। এই যৌতুকের কারণে মানুষ হয় পশু। এমন এমন পরিবার আছে যারা যৌতুকের কারণে মানসিক এবং শারীরিকভাবে নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে নারীরা এসব চাপ সহ্য করতে না পেরে অপমৃত্যুর পথ বেছে নেয় । পত্রিকার পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে যৌতুকের  নির্মম নির্যাতনের চিত্র। কেরোসিন ঢেলে গৃহবধূর গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া, উত্তপ্ত রড বা রান্নার খুন্তি দিয়ে ছ্যাকা দেওয়া, এমনকি লাঠিপেটা করা ইত্যাদি কৌশলে স্বামী-স্ত্রীকে নির্যাতন করে। 

যৌতুক প্রথার কুফল :    

১. কন্যাপক্ষকে যৌতুক প্রথার কারণে অর্থনৈতিক শোষণের শিকার হয়।
২. যৌতুকের ফলে স্বামী-স্ত্রীকে নানা নির্যাতন করে।
৩. যৌতুক না দিলে কনে শশুরবাড়িতে আদর-যন্ত এবং তার প্রাপ্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
৪.যৌতুকের কারনে পুরুষের লজ্জা হ্রাস পায়।
৫. বরের পরিবারকে যৌতুক না দেওয়ার ফলে হাজারো নারী আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

যৌতুক প্রথার কারণসমূহ

ক) শিক্ষার অভাব : মূলত অশিক্ষার কারণে যৌতুক প্রথার বিস্তার হয়ে থাকে। যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া জঘন্যতম অপরাধ। ১৯৮০ সালে যৌতুকবিরোধী আইন জারি করা হয়, তারপরেও অবাধে যৌতুক লেনদেন চলছে। মূলত অশিক্ষার কারণে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তাই এখনও যৌতুক লেনদেন চালু রয়েছে। 

খ) দরিদ্রতা : যৌতুকের প্রধান কারণ হচ্ছে দরিদ্রতা। লোভি ব্যক্তি তার দরিদ্রতা দূরীকরণের জন্য কনের পক্ষের সাথে চুক্তি করে যৌতুকের মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হয়। দরিদ্রতার কারণে কণ্যার পরিবার যৌতুক প্রদান করে, যাতে মেয়ে শশুরবাড়িতে সুখে-শান্তিতে সংসার করতে পারে।

গ) অর্থের কুপ্রভাব : যৌতুকের মূল কারণ হচ্ছে অর্থের কুপ্রভাব। মানুষ তার লোভের কারণে হারাতে বসে তার মানসম্মান। দরিদ্র পরিবারগুলো দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে যৌতুককে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। আবার সচ্ছল পরিবারগুলোও উচ্চা বিলাসী জীবনযাপনের আশায় যৌতুক প্রথাকে গ্রহন করে। 

ঘ) নারীর বিলাসী জীবনযাপন : নারীর বিলাসবহুল জীবনযাপন যৌতুকের মূল কারণ। কন্যা স্বামীর বাড়িতে সুখে শান্তিতে জীবনযাপন করবে এবং বিলাসবহুল জীবন কাটাবে। তাই কনের পরিবার যৌতুক হিসেবে নানা দ্রব্যসামগ্রী সহ নগদ অর্থ লেনদেন করে। 

ঙ) রাষ্ট্রীয় অনুশাসন উপেক্ষা করা : প্রত্যেক রাষ্ট্রেই যৌতুকবিরোধী আইন জারি করা আছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন ভঙ্গ করে এখনও যৌতুক লেনদেন চলছে। এই রাষ্ট্রীয় আইন না মানার কারণে হাজারও দাম্পত্য জীবনে কলহের সৃষ্টি করছে। আমরা সবাই জানি যৌতুক দেওয়া ও নেওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ তাও কেউই বন্ধ করছে না এই জঘন্যতম যৌতুক প্রথা।

যৌতুক প্রতিরোধে করণীয়

ক) শিক্ষালাভ : সমাজ এবং রাষ্ট্র থেকে অজ্ঞতা ও কুসংস্কার উচ্ছেদ করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষা। যৌতুক প্রথাকে বিলুপ্ত করতে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিক রয়েছে। শিক্ষা গ্রহনের কারণে যৌতুকের কুফল সম্পর্কে জানা যায় এবং অভিশপ্ত যৌতুকের হিংস্র থাবা থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে রক্ষা করা যায়। 

খ) জনসচেতনতা : জনসচেতনতা বৃদ্ধির ফলে যৌতুক লেনদেন রোধ করা যাবে। এমনকি জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য মিডিয়াতে যৌতুকের কুফল সম্পর্কে প্রচার করা যেতে পারে। অথবা স্কুল এবং কলেজে শিক্ষক যৌতুকের কুফল সম্পর্কেও অলোচনা করতে পারে। পত্র-পত্রিকায় এর কুফল প্রকাশ করা যেতে পারে। তবেই মানবজাতি জঘন্যতম যৌতুক প্রথা থেকে রক্ষা পাবে। 

উপসংহার : যৌতুক প্রথা একটি সামাজিক ব্যাধি। এ ব্যাধি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এ ব্যাধির কারণে ঘরে কণ্যাসন্তান জন্মিলে স্ত্রীকে-স্বামী তাকাল পর্যন্ত দিয়ে থাকে। যৌতুকের কারণে মানুষ হয় লোভী এবং বিবেকহীন। যৌতুক যখন ধীরে ধীরে সামাজিক নীতিতে রূপান্তরিত হয়, তখনই সেটা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়। যোগ্যতা কিংবা গুণ নয়, অর্থনৈতিক আবস্থান হয় বিবাহের মূল কারণ,যা অবশ্যই সঠিক নয়। যৌতুক গ্রহণের মতো এমন একটা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে আমরা না বলি। যৌতুকের মতো হিংস্র থাবা থেকে মুক্তি পেতে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তার পাশাপাশি জনগনকে সচেতন হতে হবে। তবেই সমাজ থেকে যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধি বিলুপ্ত করা সম্ভব হবে।

যৌতুক প্রথা / পণপ্রথা PDF Format

 

অন্যান্য রচনা
একটি শীতের সকাল
পলিথিন মুক্ত বাংলাদেশ ও পরিবেশ বিশুদ্ধকরণ
মোবাইল ফোন

 

Facebook
Pinterest
Reddit