অথবা, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান
অথবা, ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থান
অথবা, জুলাই বিপ্লব
ভূমিকা : বাংলাদেশে ২০২৪ সালে সংঘটিত কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল দাবি ছিল সরকারি চাকরিতে কোটার পরিমাণ কমিয়ে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ প্রদান করা। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনবার কোটা সংস্কার আন্দোলন হয়। এই আন্দোলনের পক্ষে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে এই আন্দোলনের বিপক্ষে রয়েছে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সহ ক্ষমতাসীন দলের প্রায় সকলেই। ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম বড় ধরনের কোটা সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের দিকে আন্দোলনকারীদের যৌক্তিক দাবিকে সমর্থন করে সরকার পরিপত্র জারি করে। কিন্তু ২০২৪ সালে হাইকোর্ট পরিপত্রটি অবৈধ ঘোষণা করেন, ফলে ২০২৪ সালে পুনরায় আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। প্রতিবার আন্দোলনের সময় পুলিশ বাহিনী এবং ছাত্রলীগ যৌথভাবে আন্দোলনকারীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায়।
পটভূমি : ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জনের পরে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা প্রচলন ঘটে। সে সময় মেধাতালিকা ২০ শতাংশ, জেলা কোটা ৪০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ এবং নারী কোটা ১০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার এই কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশের বেশি কোটা রয়েছে যার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩০ শতাংশ, নারী কোটা ১০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক কোটা ১০ শতাংশ এবং ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের জন্য ৫ শতাংশ। তবে নিয়ম অনুযায়ী এসব কোটার যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে তবে ১ শতাংশ প্রতিবন্ধীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। যার ফলে ৪৪ শতাংশ চাকুরী প্রার্থী উত্তীর্ণ হতো। সাধারণ পরীক্ষার্থীদের মধ্যে বড় একটা অংশই বঞ্চিত হতো যার ফলে সৃষ্টি হতে থাকে চরম অসন্তোষ।
বাংলা ব্লকেড ও শিক্ষার্থীদের উপর হামলা : জুলাই মাসে আন্দোলন আরও তীব্র রূপ ধারণ করে, যেখানে “বাংলা ব্লকেড” সহ অবরোধ কর্মসূচি চালায় শিক্ষার্থীরা। এ সময় আন্দোলন দমাতে পুলিশ বাহিনী অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ করে, যার ফলে সংঘর্ষ ঘটে এবং রংপুরের আবু সাঈদ নামে এক শিক্ষার্থী পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। এই ঘটনাটি আন্দোলনকে আরো জোরালো করে তোলে এবং দেশ জুড়ে উত্তেজনা তৈরি হয়। এরপরে ঢাকাসহ সারাদেশে আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের হামলায় অনেক হতাহত হয়। ফলে এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সারাদেশে কারফিউ জারি করার পাশাপাশি ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয়। আন্দোলনের তীব্রতার ফলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়।
সরকার কর্তৃক গণহত্যা : আন্দোলনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনায় ব্যর্থ হয়ে সরকার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এবং ছাত্রলীগ বাহিনী দিয়ে ছাত্র-জনতার উপর গণহত্যা শুরু করে। একসময়ে ছাত্র থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারী, কেউ হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাইনি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শিশুরাও নির্মমভাবে প্রাণ হারায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং অন্যান্য উপকমিটির বিবৃতি অনুযায়ী, ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে নিহতের সংখ্যা ১৫৮১ জন। আর ১২৭ জন শিশুর প্রাণ হারায়। আবু সাঈদ এবং মীর মুগ্ধ নামে দুই আন্দোলনকারীর নির্মম মৃত্যু জাতির বিবেককে নাড়িয়ে দেয়।
এক দফা দাবি : আওয়ামী লীগ সরকারের দমন-নিপীড়ন গণহত্যার রূপ নিলে, দেশের ছাত্র-জনতা সরকারের পদত্যাগের জন্য এক দফা দাবি ঘোষণা করে। এক সময়ে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ দাবি করা হয়। ফলে “দফা এক, দাবি এক, শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং “স্টেপ ডাউন হাসিনা” সহ বিভিন্ন স্লোগান রাজপথে কম্পিত হয়। এই আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণ ও গণহত্যার মুখে সরকার পতনের ফলে এই আন্দোলনকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলে অভিহিত করা হয়।
আওয়ামীলীগ সরকারের পতন : ঢাকায় আন্দোলন শুরু হওয়া অবস্থায় দেশের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা আন্দোলনে যুক্ত হয়। তারা সিদ্ধান্ত নেয় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ঘেরাও, যা পরিস্থিতিকে আরো উত্তপ্ত করে তোলে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ, টিয়ারগ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেডের ব্যবহার ঢাকা শহর এক আতঙ্কের নগরীতে পরিণত হয়। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ্জামান প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগের পরামর্শ দেন। এক পর্যায়ে এই গণহত্যার বিচারের ভয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যায়। এই আন্দোলনের সফলতা দেশের জনগণের জন্য নতুন আসার সঞ্চার ঘটায় এবং এটিকে জাতি দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত করে।
উপসংহার : ২০২৪ এর কোটা সংস্কার আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সৃষ্টি করে। সরকারি চাকরির নিয়োগে কোটা পদ্ধতি সংস্কারে ছাত্র জনতার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। পুলিশ বাহিনীর নিপীড়ন এবং ব্যাপক হত্যাকাণ্ড আন্দোলনকে আরো উত্তপ্ত করে তোলে। এক পর্যায়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন ঘটে। এই আন্দোলনে কোটা ব্যবস্থা সংস্কার সহ সরকারের অপশাসনের বিরুদ্ধে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়, যা দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে অভিহিত হয়। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে, যে কোনো স্বৈরাচারী সরকারই জনগণের ন্যায্য দাবির মুখে টিকে থাকতে পারবে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলন ২০২৪ PDF Format
অন্যান্য রচনা
কাগজ
প্রতিবন্ধীদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য
একটি গাছ একটি প্রাণ