মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার, মাদকাসক্তির ও তার কুফল, মাদকাসক্তির পরিণাম

মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার

অথবা, মাদকাসক্তির ও তার কুফল
অথবা, মাদকাসক্তির পরিণাম 

ভূমিকা : আমরা সকলেই জানি মাদকদ্রব্য স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। কিন্তু মাদকাসক্তি  ব্যক্তি একথা কে উপেক্ষা করে বন্ধ করছে না তার মাদক গ্রহণ। ক্রমশ দেশে বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকদ্রব্য, এ যেন এক তীব্র নেশা। যুবসমাজে এক আদিম প্রবনতা হচ্ছে মাদকদ্রব্য। এই নেশায় লিপ্ত হাজার হাজার তরুণ। দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর বন্দরে, এমনকি গ্রামে, শহরতলিতে। এই মৃত্যুময় নেশা দূর করতে যুবসমাজকে বাঁচাবার উপায় যদি উদ্ভাবিত না হয়, তবে ধুলিসাৎ এ পরিণত হবে জাতির স্বপ্ন। 

মাদকাসক্তি কী : একটি স্নায়ুবিক ধারণা হচ্ছে মাদকাসক্তি। এটি গ্রহণের প্রভাব তীব্র হওয়ার ফলে ব্যক্তির আচার-আচরণ, চিন্তা চেতনা পরিলক্ষিত হয়। মাদকাসক্তি বলতে বোঝাই মাদকদ্রব্য কিংবা ড্রাগ এর প্রতি অতি আকর্ষণ।

মাদকদ্রব্য কী : নেশা সৃষ্টি জাতীয় দ্রব্যকেই মাদকদ্রব্য বলে। মূলত যে দ্রব্য গ্রহণের ফলে নেশা কিংবা আসক্তিতে জন্ম নেয় তাকে মাদকদ্রব্য বলা হয়। সহজ ভাষায় বলতে গেলে যে দ্রব্য মস্তিকতের অনাকাঙ্ক্ষিত বেকার ঘটিয়ে বিভ্রান্ত নেশা সৃষ্টি করে তা মাদকদ্রব্য। 

মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ : মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ মূলত দুই প্রকার –

১| প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য
২| রাসায়নিক মাদকদ্রব্য

প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য : প্রাকৃতিক সাহায্যে যেসব মাদক দ্রব্য ক্রয় করা হয় তাকে প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য বলে। যেমন : গাজা, ভাং, তাড়ি, আফিম। 

রাসায়নিক মাদকদ্রব্য : পরীক্ষা অনুযায়ী রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে যেসব দ্রব্য সৃষ্টি করা হয় তাকের রাসায়নিক মাদকদ্রব্য বলে। যেমন : মদ, এলএসডি, প্যাথেডিন ও হেরোইন। 

মাদকাসক্তি কাকে বলে : নিয়মিত মাদকদ্রব্য গ্রহণের ফলে শারীরিক ও মানসিক ব্যাঘাত সৃষ্টি করে ও ক্রমশই ওই দ্রব্যের প্রতি আকর্ষণের মাত্রা বাড়তে থাকে সেসব অবস্থানকে মাদকাসক্তি বলা হয়। মাদকাসক্তির ফলে মানুষের ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিবৃত্তি, ইচ্ছা শক্তিকে এমনভাবে ক্ষতিসাধন করে তা বলে বোঝানো মুশকিল। ড্রাগের সাথে মাদকাসক্তির গভীরভাবে সম্পর্ক রয়েছে। ড্রাগ মূলত ঔষধ যা রোগ নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু ড্রাগের এই অপব্যবহার সৃষ্টি করছে আসক্তি(Addiction)।  

মাদকাসক্তির সম্ভাব্য কারণসমূহ :
১| সহজ আনন্দ গ্রহণের আশায় মাদক সেবন ;
২| সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালোবাসা বা মায়া না থাকার অভাব ;
৩| হতাশা এবং আর্থিক সংকট ;
৪| বন্ধু বা সঙ্গী সাথীদের আড্ডায় মাদক গ্রহণ ;
৫| ক্ষনেকের উত্তেজনা বা নতুন স্বাদ গ্রহণের কৌতুহল ;
৬| প্রেমের ব্যর্থতা কিংবা ভালোবাসায় বিচ্ছেদ হলে ;
৭| ব্যক্তি যখন অভাব বা ত্রুটি অনুভব করে ;
৮| সঙ্গ দোষ কিংবা পারিপার্শ্বিক চাপ ;
৯।এমনকি মাদকাসক্তি ঘটতে পারে মা-বাবার অতিরিক্ত আস্কারা এবং আদরের কারণে। 

মাদকাসক্তির লক্ষণ :
১| নতুন নতুন বন্ধুর আগমন ;
২| অজুহাত দেখিয়ে ঘনঘন টাকা আদায় ;
৩| রাত জাগা এবং দিনে ঘুমানোর প্রবণতা ;
৪| ঘনঘন চা খাওয়ার পাশাপাশি সিগারেট পান করা এমনকি মাত্রা ছাড়া মিষ্টি খাওয়া।
৫| বারবার পাতলা পায়খানা ;
৭| অতিরিক্ত ঘুমের আগমন এবং অস্থিরতা বোধ করা ;
৮| টয়লেটে সময়ের পর সময় কাটানো ;
৯| ওজন কমে যাওয়া এমনকি খাবার কম খাওয়া ;
১০| যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধি, অকারনে বিরক্ত অনুভব করা।

মাদকাসক্তির কুফল : সর্বনাশী ব্যাধি হিসেবে বিবেচনা করা যায় বর্তমান বাংলাদেশের মাদকাসক্তিকে। সকল পেশা এবং সকল বয়সের, বৃদ্ধ, শহর কিংবা গ্রামে ভয়ংকর ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই নেশা যা জনশক্তিকে দুর্বলে পরিণত করছে। যার ফলে নতুন কিছু আবিষ্কারের সম্ভাবনার সংখ্যা কমছে। পাশাপাশি সামাজিক সম্পর্কের দূরত্ব ঘটছে। এটা প্রমাণিত, মাদকদ্রব্য গ্রহণের কোন ভালো দিক নেই। এটি গ্রহণের ফলে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। 

মাদক প্রতিরোধে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ : ধীরে ধীরে মাদকদ্রব্যের অবৈধ পাচার ও অপব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৯০ সালের ২ জানুয়ারি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মূলত রাষ্ট্রপতির সচিবালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালের দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনা হয়। 

মাদকদ্রব্য উৎপাদন বা অবৈধ পাচার রোধে সরকারের যে সকল আইন প্রণয়ন–
১| মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কোডিং মিশ্রিত কফ সিরাপ, ট্যাবলেট, হেলথ টনিক উৎপাদন নিষিদ্ধ।
২| গাঁজা চাষ বন্ধ (১৯৮৭), গাজার দোকান বন্ধ (১৮৮৯)।
৩| মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের আইন প্রণয়ন(১৯৯০)।
৪| মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে তহবিল বিধিমালা (২০০১)
৫| মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আইন (২০১৮) সাজা  হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান প্রচার করা হয়।  

মাদক সমস্যা নিয়ন্ত্রণে করণীয় : মাদকাসক্তি হচ্ছে একটি জাতীয় সমস্যা। সমাজ, রাষ্ট্র, পরিবার সহ সকল পর্যায়ের ব্যক্তি এই সমস্যায় জড়িত। তাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য যার যার অবস্থান থেকে জোড়ালো ভুমিকা লালন করতে হবে। 

রাষ্ট্র বা সরকারের করণীয় :
১| নতুন আইন প্রণয়ন ;
২| ধ্বংস করা এই সর্বনাশা নেশার উৎস;
৩| ড্রাগ উৎপাদন নির্দেশ করে বিধিমালা প্রণয়ন ;
৪| মাদকদ্রব্য ব্যবসায়িকর ব্যক্তিদের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় পদত্যাগের পাশপাশি কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নির্দেশ ;
৫| মাদক ব্যবসায়ীদের সাথে মেলামেশা বা জড়িত থাকা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা এবং শাস্তির ব্যবস্থা ;
৬| মাদকের চোরা চালান / পাচার রোধে শাস্তির আওতায় আনা ;

সমাজ ও পরিবারের করণীয় :
১| মাদকাসক্তি ব্যক্তিদের মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থার পাশাপাশি তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ ;
২| মাদকাসক্তি কুফল ও এর কোনো ভালো দিক নেই, রয়েছে ভয়ানক পরিণতি তা সম্পর্কে সকলকে সচেতন করা;
৩| সন্তানের মাধ্যমে বিড়ি বা সিগারেট ক্রয় করা থেকে বিরত থাকা ;
৪| অবসর সময় পেলে সন্তানের সাথে সময় কাটানো ;
৫| সন্তানের সাথে পিতা-মাতার বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি করা ;
৬| সন্তানদের ধর্মীয় শিক্ষায় নিয়োজিত করা ;
৭| সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সমাবেশ রচনা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত করা।  

যুব সমাজের করণীয় :
১| মাদকদ্রব্য গ্রহণকারী ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকা ;
২| মাদক গ্রহণকারী বন্ধুদের সাথেও আড্ডা না দেওয়া ;
৩| শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিজেকে উপস্থিত রাখা ;
৪| অবসর সময়ে বিনোদন উপভোগ ও খেলাধুলা করা;
৫| নিষ্ঠা এবং দেশ প্রেমের সাথে জীবন পরিচালনা করা ;
৬| ধূমপান থেকে দূরে থাকা;
৭| শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে কিংবা স্কুল কলেজে মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে আলোচনা করা।

উপসংহার : মাদকাসক্তির এই ভয়াবহ পরিনাম কত তরুণকে যে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। আবার কত পরিবারকে যে  ধ্বংস করেছে তা সকলেরই জানা। এমন অবস্থা থেকে যুবসমাজদের রক্ষা করার পাশাপাশি মাদকদ্রব্যের চোরা / পাচার ব্যবস্থাকে বন্ধ করতে হবে। ধর্ম, বর্ণ,মত, দল নির্বিশেষে সবাই মিলে মাদককে না বলি এবং সমাজকে মাদকমুক্ত গড়ে তুলি। তবেই মাদকাসক্তি থেকে জাতি রক্ষা পাবে। 

 

মাদকাসক্তি ও তার প্রতিকার PDF Format

 

 

অন্যান্য রচনা
স্বদেশ প্রেম / দেশাত্মবোধ
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা
সড়ক দুর্ঘটনা ও তার প্রতিকার

 

Facebook
Pinterest
Reddit