অথবা, দারিদ্র বিমজনের তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার
অথবা, তথ্য প্রযুক্তি ও বাংলাদেশ
অথবা, জাতীয় উন্নয়নের তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা
ভূমিকা : বাংলাদেশের উন্নতির প্রধানতম শর্ত হলো তথ্যপ্রযুক্তিগত অগ্রগতি সাধন। শুধু বাংলাদেশ নয়, আরো বিভিন্ন দেশের উন্নতি সাধন হয়েছে এই তথ্যপ্রযুক্তির ফলে। ১৭৮৯ সালে ইউরোপের শিল্পবিপ্লবের পর থেকে বিশ্বজুড়ে তথ্যপ্রযুক্তি, যোগাযোগ এবং বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের জোয়ার বইতে শুরু করে। বর্তমান পৃথিবীর উন্নয়ন এবং দারিদ্র-বিমোচনের মূল চাবিকাঠি হলো তথ্যপ্রযুক্তি। প্রযুক্তিগত উন্নয়নই এখন জাতিগত উন্নয়নের মানদন্ড। জ্ঞানবিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে পৃথিবী পরিমণ্ডলে নিজ অবস্থান উজ্জ্বল করতে তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা রয়েছে। ভবিষ্যতের বৈশ্বিক অগ্রগতিকে এই খাতই নেতৃত্ব দেবে। এমনকি আর্থসামাজিক কাঠামোকে শক্ত ভিত্তি প্রদান করবে। বিশ্ব উন্নয়নের সুবিশাল আঙিনায় তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল অবদানের ফলে সম্ভাবনার যে জগৎ সৃষ্টি হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ শিশুবৎ হলেও আস্তে আস্তে অগ্রগতি সাধন করছে।
তথ্যপ্রযুক্তি কী : তথ্য সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াকরণ ব্যবস্থাপনা এবং বিতরনের জন্য ব্যবহারিত প্রক্রিয়া ও পদ্ধতির সমন্বয়কে তথ্যপ্রযুক্তি বলা হয়। তথ্যপ্রযুক্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে কম্পিউটিং, মাইক্রো ইলেকট্রনিক্স, টেলিকমিউনিকেশন ইত্যাদি।
তথ্যপ্রযুক্তির বৈশিষ্ট্য : তথ্যপ্রযুক্তির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ লক্ষ্য করা যায় :
১. তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার একই সময়ে আমাদের কাজের এবং খরচ দুটোই কমিয়েছে।
২. উন্নত প্রযুক্তি লেনদেন এবং তথ্য যোগাযোগে দ্রুত পরিবর্তন ঘটাচ্ছে।
৩. চিকিৎসা, শিক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের গতিকে সহজ করেছে।
৪. তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ব্যবসা বাণিজ্যকে অধিক লাভজনক করেছে ।
৫. তথ্যপ্রযুক্তি উৎপাদনের সব ক্ষেত্রে অপচয় কমিয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির কয়েকটি বিশেষ দিক : সফটওয়্যার, নেটওয়ার্ক, ডেটাবেজ, মুদ্রণ ও রিপ্রোগ্রাফিক প্রযুক্তি ইত্যাদি সবই তথ্যপ্রযুক্তির এক একটি উল্লেখযোগ্য দিক।
তথ্যপ্রযুক্তি ও বর্তমান বাংলাদেশ / তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের বর্তমান অবস্থা : তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষের দূরত্ব এবং সময় কমাচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির স্পর্শে ধীরে ধীরে বাংলাদেশও উন্নতি লাভ করছে। নব্বইয়ের দশক থেকে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশ ব্যাপক উন্নতি সাধন করছে। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম তথ্যপ্রযুক্তির দিকে অনেক বেশি ঝুঁকে পড়েছে। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, সফটওয়্যার, কম্পিউটার, মাইক্রোসফট ইত্যাদি ব্যবহারে এদেশের ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ, অনেক বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বেড়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার : কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল শিক্ষাবিস্তারের জন্য বাংলাদেশে ১৯৮৪ সালে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কম্পিউটার প্রকৌশল বিভাগ স্থাপিত হয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা চালু হয় এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি প্রোগ্রামের মাধ্যমে। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট কোর্স চালু হয়। এভাবে আস্তে আস্তে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ ঘটতে শুরু করে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার জীবনযাত্রার মান বদলে দিতে সক্ষম। এজন্য তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশে অনেক বেড়েছে। বর্তমান বাংলাদেশের কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, ইন্টারনেট এবং তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৭/৮ হাজারের মত। সারাদেশে স্থাপিত হয়েছে কম্পিউটার হার্ডওয়ারের শোরুম। সফটওয়্যার প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও শতাধিক।
তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত প্রসারে পদক্ষেপ : বর্তমানে আমাদের দেশে কম্পিউটার মেলা, প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা, ওয়েব ডিজাইন প্রতিযোগিতা ইত্যাদি অহরহ হচ্ছে। বর্তমানে দেশে ই-কমার্স এর ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে । তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুতপ্রসারের লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে সরকারের পদক্ষেপ :
১. তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো। এজন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতি করা হচ্ছে। বর্তমান সারা দেশ ডিজিটাল টেলিফোনের আওতায়। দেশের প্রতিটি জেলায় পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট।
২. সরকার তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুত প্রসারের লক্ষ্যে ‘জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা’ অনুমোদন করেছে। এই নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রয়াসে সরকার ঢাকার প্রাণকেন্দ্র কারওয়ান বাজারে ৭০ হাজার বর্গফুট আয়তনের ফ্লোরে অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত একটি ‘আইসিটি ভবন’ স্থাপন করেছে।
৩. সরকার জেলা উপজেলা ও থানা পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা প্রদান করেছে।
৪. দ্রুতগতির ইন্টারনেট ওয়াই-ফাই, 3G, 4G কে, সরকার অনুমোদন দিয়েছে।
৫. তথ্যপ্রযুক্তি প্রসারের লক্ষ্যে ঢাকার অদূরে কালিয়াকৈরে ২৬৫ একর জমিতে হাইটেক পার্ক স্থাপন করেছে।
তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে রপ্তানি আয় : দেশে কম্পিউটার সফটওয়্যার তৈরি বেশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিবছর ২০০ কোটির টাকার অধিক সফটওয়্যার বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালায় আগামী ৩ বছরের মধ্যে সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সফটওয়্যার রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের জন্য করণীয় : তথ্যপ্রযুক্তির উন্নতি বাংলাদেশের মতো জনসংখ্যাবহুল দেশে অত্যন্ত আবশ্যক। তাই প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়মুখী উচ্চশিক্ষাকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক করে গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরী। এজন্য সরকারকে সকল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে শক্তিশালী ও সক্রিয় করে তুলতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির সদ্ব্যবহার উন্নত দেশগুলোর পক্ষে করা সম্ভব হয়েছে তার মূল কারণ তাদের রাষ্ট্র, বাজার এবং সমাজের উদ্যোগ ও সুদূরপ্রসারী ভূমিকার ফলে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে উন্নত দেশ এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে এই ধরনের বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইংরেজিতে একে বলে Digital Divide, বাংলায় বলে ডিজিটাল বৈষম্য।
তথ্য প্রযুক্তির কার্যক্রম ব্যবহার : একুশ শতকের এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশকে টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন যোগ্যতা এবং তথ্যপ্রযুক্তির নবতর কৌশল আয়ত্তে আনা। আমাদের দেশে শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে তাদের যোগ্যতা বারবার প্রমাণ করেছে। এজন্য আমাদের এই তরুণদের মেধা, সৃজনশীলতা এবং তাদের উদ্ভাবনী শক্তিকে ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য কার্যকরী করে গড়ে তুলতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক শিক্ষার প্রসার : বাংলাদেশকে এ প্রতিযোগিতামূলক যুগে টিকে থাকতে হলে আমাদের দেশের তরুণ সমাজকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। এজন্য বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে করে তাদেরকে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষায় রূপান্তরিত করতে হবে। প্রতিটি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক স্বতন্ত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষার ক্ষেত্রে গ্রাম অথবা শহরের মাঝে বিদ্যমান বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। গ্রাম অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা যাতে তথ্যপ্রযুক্তির জ্ঞান অর্জনের সমান সুযোগ-সুবিধা পায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা খাতে যথেষ্ট পরিমাণ বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষ সরকারব্যবস্থা গঠন : তথ্যপ্রযুক্তি উন্নয়নের মাধ্যমে জাতীয় উন্নয়ন সাধন করার জন্য দরকার তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষ সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এজন্য করণীয় হলো :
১.সরকারি তথ্যে অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিতকরনের জন্য ইন্টারনেটভিত্তিক তথ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
২. সকল সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে ই-মেইল ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা।
৩. সরকারের বিভিন্ন সেবা যেমন আমদানি রপ্তানি লাইসেন্স, নাগরিত্ব নিবন্ধন ও স্বত্বাধিকার, ট্রেডমার্ক, এবং জমি নিবন্ধন সেবা ইন্টারনেটের আওতায় আনা।
৪. সরকারি সুবিধা তথা বেতন, অবসর ভাতা ইত্যাদি ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রদানের ব্যবস্থা করা।
উপসংহার : সারা বিশ্বে তথ্য ও প্রযুক্তি বিদ্যার বিজয় ঘোষিত হচ্ছে। ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির চর্চাগত দিক, এমনকি এটি সূর্যকিরণের মতো সম্প্রসারিত হচ্ছে। তাই এই প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে বাংলাদেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের কোন বিকল্প নেই। তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে দারিদ্রতা দূরীকরণ ও যুবকদের বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তির বিকাশের মাধ্যমে আমাদের দেশের আর্থসামাজিক সমস্যা দূর করাও সম্ভব।
বাংলাদেশের উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা PDF Format
অন্যান্য রচনা
শহীদ তিতুমীর
বই পড়ার আনন্দ
প্রিয় কবি (কাজী নজরুল ইসলাম)