khadde vejal

খাদ্যে ভেজাল ও মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম্য 

ভূমিকা : মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাদ্য। খাদ্য ছাড়া মানুষের জীবনের অস্তিত্বের কথা ভাবা মুশকিল। কিন্তু বর্তমানে খাদ্যেও নানা রকমের ভেজাল দ্রব্য মেশানো হচ্ছে। যা মানবজীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এমনকি এটি অমানবিক গর্হিত ব্যাপার। কেননা, মানুষের কল্যাণের জন্যই খাদ্য। কিন্তু ভেজাল দ্রব্য মিশিয়ে খাদ্যকে করে তুলছে বিষাক্ত যা অপরের অকল্যাণ ডেকে আনছে এমনকি এতে মনুষ্যত্বেরই অপমান হচ্ছে। মানুষ টাকার লোভে খাদ্যে ভেজাল মেশায়। বিষাক্ত খাবার গ্রহণে অনেকেই মৃত্যুর মুখে ধাবিত হচ্ছে। একদিকে দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্যে চাহিদা মেটানো অসম্ভব হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে যতটুকু সামর্থ্য আছে, ক্রয়ের সেই জিনিসেও ভেজাল মেশানো থাকে। ফলে এই বিষাক্ত খাবার গ্রহণে প্রতিদিনই অসংখ্য মানুষ বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠী বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবার আওতায় আসেনি। ফলে তারা ঝুঁকিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করছে। ভেজাল দ্রব্য মেশানো মানুষ হিসেবে মনুষ্যত্বের অপমান ও মানবজাতির জন্য অকল্যাণকর। তাই যত দ্রুত সম্ভব খাদ্য ভেজাল  রোধ করা।

খাদ্যে ভেজাল : মানুষ সামাজিক জীব। জীবন পরিচালনার জন্য তাকে অন্যের সহযোগিতা নিতে হয়। খাদ্যদ্রব্যের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু বিক্রেতাগণ টাকার লোভে অনেক সময় খাবারে ভেজাল দ্রব্য মিশিয়ে থাকে। এটি মানুষের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। খাদ্যে নিম্নমানের বা ক্ষতিকর ও অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য মেশালে তাকে ভেজাল বলে। প্রকৃতিগত এবং গুণগত নির্ধারিত মানসম্মত না হলে যে কোন খাবারই ভেজাল যুক্ত বলে বিবেচিত হয়। মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর এবং মেয়াদউত্তীর্ণ দ্রব্য যদি কোনো খাবারে মেশানো হয় তখন সেটা ভেজাল খাদ্যে পরিণত হয়। আবার খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণের তুলনায়  কম উপাদান থাকলে সে খাদ্যেও ভেজালযুক্ত। 

খাদ্যে ভেজালের প্রকৃতি : আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রায় প্রতিটি খাদ্যে ভেজালের আশঙ্কা রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, আমরা যেসব খাবার গ্রহণ করে থাকি তার অর্ধেকের বেশি ভেজালযুক্ত। বিভিন্নভাবে খাদ্যের সাথে ভেজাল মেশানো হয়ে থাকে। যেমন- চালের সাথে পাথর, বালি মেশানো, ডালে ক্ষতিকারক রং ছত্রাক থাকে। আবার বিস্কুট, নুডুলস, পাউরুটি, আটা এবং ময়দায় ৯০ ভাগ ভেজাল, নিম্নমানের ও খাবার অনুপযোগী। বাজারে যেসব  বোতল বিক্রি হয় তার, প্রায় ৯৬ ভাগ পানের উপযুক্ত নয়। এমনকি বাজারে যেসব জুস পাওয়া যায়, তার প্রায় ৯৭ ভাগই ফলের জুস সমৃদ্ধ নয়। তাছাড়া অন্যান্য দ্রব্য যেমন জুস, জ্যাম, জেলিতে যেসব রং ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

মানুষের খাদ্যের তালিকায় অপরিহার্য অংশ হলো ফলমূল এবং শাকসবজি। বর্তমানে এসব খাবারকে দীর্ঘক্ষণ সতেজ এবং পাকানোর জন্য ব্যবহৃত হয় ক্যালসিয়াম কার্বাইডসহ বিভিন্ন বিষাক্ত কেমিক্যাল। মাছে-ভাতে বাঙালি কথাটা বলা হলেও আজ মাছ খেতে গেলেও মনে ভয়ের আশঙ্কা থাকে। কেননা আজকাল মাছে ফরমালিন মেশানো যেন নিয়মমাফিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বলতে গেলে, বর্তমানে মাছ মাংস এখন আর টাটকা পাওয়া যায় না। শুটকি মাছে মেশানো হচ্ছে বিষাক্ত কীটনাশক যা মানবদেহে ক্যান্সার ও হৃদরোগসহ বহুবিধ রোগ সৃষ্টি করে। বাজারে যেসব লবণ পাওয়া যায় তার প্রায় ৯০ ভাগ লবণ আয়োডিনযুক্ত নয়। খাবারের বিভিন্ন রকম মসলা, বিশেষ করে প্যাকেটজাত গুঁড়া মসলায় ভেজাল মেশানো থাকে। বর্তমান বাজারে খাঁটি দুধ পাওয়া মুশকিল। এমনকি প্যাকেটজাত গুড়া দুধে বিষাক্ত মেলামিন আতঙ্ক সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। অর্থাৎ আমরা বাজার থেকে যেমন প্রকার খাবার নেই না কেন, তাতে ভেজাল নেই, এমনটা বলা অসম্ভব। 

মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম্য : বর্তমান সমাজ দাঁড়িয়ে আছে মুনাফাভিত্তিক অর্থনীতির উপর। এখানে সমস্ত দ্রব্য উৎপাদিত হয় মুনাফার উদ্দেশ্যে। আর প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মুনাফার পেছনে যে যত বেশি ছুটতে পারে, তার শক্তি তত বেশি। বর্তমান ব্যবসায়ীগণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজন মেটানোর কথা না ভেবে, কিভাবে তারা অধিক মুনাফা অর্জন করবে সেটাতেই মগ্ন থাকে, অন্যদিকে মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণের চিন্তা তাদের মাথায় আসেনা। তাই মানুষের খাদ্যদ্রব্যে মেশানো হয় ভেজাল। কেননা খাবারে ভেজাল মেশানোর ফলে তারা অধিক মুনাফা অর্জন করতে পারবে। উঁচু পর্যায়ের শিল্প কলকারখানার মালিক থেকে শুরু করে ফুটপাতে অবস্থানরত খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত আজকাল খাবারে ভেজাল মেশানোর কারবারের সাথে যুক্ত রয়েছে। অসহায় শিশু বিষাক্ত দুধ খেয়ে মারা যাচ্ছে। খাদ্য বিষক্রিয়ার সঠিক চিকিৎসা না পাওয়ায় মহামারী নেমে আসে গরিবের ঘরে। খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ পুষ্টিমান থাকেই না, বিভিন্ন ভেজাল মিশ্রিত থাকায় দেশের জনগণের স্বাস্থ্যের অবস্থা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। মুনাফালোভীদের  এই দৌরাত্ম্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব জনগণ। এতে জনস্বাস্থ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় বাংলাদেশকে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়তে হবে। 

ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রভাব : বর্তমানে বাজারে ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের বিস্তার ভয়াবহ আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে জনসাধারণের স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। খাদ্য ভেজালের কারণে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে জটিল রোগ। মারাত্মক কিডনি রোগের সংখ্যা এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে বহু গুনে। দেশে বর্তমানে কিডনি রোগের সংখ্যা প্রায় দুই কোটির বেশি, দশ বছর আগেও এর সংখ্যা ছিল ৮০ লক্ষের নিচে। মারাত্মক খাদ্য ভেজালের কারণে দেশে প্রতিবছর ৮৫ হাজারের বেশি নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ফরমালিন, কার্বাইড, হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ইত্যাদি মানবদেহে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করছে। ফলে দেশে ব্যাপকমাত্রায় বৃদ্ধি পাচ্ছে পেটের পীড়া, শ্বাসকষ্ট, বদহজম, ডায়রিয়া, আলসার চর্মরোগ, লিভার সিরোসিস ক্যান্সার ইত্যাদি। কিডনি রোগ, ক্যান্সার, হৃদরোগের মতো দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অনেকে অকালে মৃত্যুবরণ করছে। ক্ষতিকর কেমিক্যালযুক্ত খাবার খেয়ে মানুষের স্মৃতিশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। মূলত অর্থের লোভে খাদ্য মেশানো হচ্ছে ভেজাল। আর এই ভেজাল মিশ্রিত খাবার খেয়ে মানুষকে স্বাস্থ্যহীন করছে এবং ঠেলে দিচ্ছে মৃত্যুর মুখে। খাদ্য ভেজাল রোধ না করলে বাংলাদেশের উন্নতি অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়বে। 

খাদ্যে ভেজাল রোধে করণীয় : মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন খাদ্য। অথচ মুনাফালোভী পুঁজিপতিরা নির্বিচারে খাদ্যে ভেজাল মিশ্রিত করছেন, এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায় বাংলাদেশের জনগণ ভয়াবহ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে। প্রতিনিয়ত ঝরে পড়ছে অসংখ্য প্রাণ, যা সভ্য সমাজের জন্য কলঙ্কজনক অধ্যায়। অতি দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। প্রথমত, অর্থলোভী ব্যবসায়ীদের অধিক মুনাফা লোভের কমাতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকার ও জনগণের একসঙ্গে সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। 

ভেজাল খাদ্য রোধে নিচের পদক্ষেপ গুলো আমরা গ্রহণ করতে পারি –

১.শাস্তি মূলক ব্যবস্থা : খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
২.অভিযান পরিচালনা : খাদ্যে ভেজাল মেশানো দূরীকরণের জন্য নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে।
৩. যৌথ পরিকল্পনা : খাদ্যে যেন ভেজাল মেশানো না হয়, সেজন্য খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান গুলোর সাথে সরকারের যৌথ পরিকল্পনা করতে হবে।
৪. মান নিশ্চিতকরণ : খাদ্য অধিদপ্তর ও বিএসটিআই কর্তৃক নির্ধারিত মান ও পুষ্টির পর্যাপ্ততা অনুযায়ী খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে খাদ্য উৎপাদনে বাধ্য করতে হবে।
৫.অনুমোদন : যেসব খাদ্যদ্রব্য অনুমোদিত নয়, কিন্তু এসব দ্রব্য বাজারে প্রচুর ছড়িয়ে পড়েছে, তা অনেক সময় ভেজাল যুক্ত হয়ে থাকে, সেজন্য সকল পণ্যের অনুমোদন নিশ্চিত করতে হবে।
৬.জনসচেতনতা বৃদ্ধি : খাদ্যে ভেজাল মুক্ত করতে চাইলে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ভেজাল বিরোধী মানসিকতা এবং জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তাহলে খুব সহজে কেউ খাদ্যে ভেজাল মেশাতে পারবে না। 

উপসংহার : ‘খাদ্য ভেজাল’ কথাটি এখন আর নতুন নয়। কিন্তু ক্ষতিকর প্রভাব সমাজে নিত্য রূপ গঠন করছে। দেশের জনস্বাস্থ্য এবং আগামী প্রজন্ম মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ছাড়া বাংলাদেশের ভাগ্যের পরিবর্তন অসম্ভব। তাই অকালে মৃত্যুতে ঢলে পড়া মানুষদের রক্ষার জন্য খাদ্য ভেজাল রোধে কঠিন এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরী হয়ে পড়েছে। সচেতন ও বিবেকবান মানুষেরা এগিয়ে আসবে ভেজাল নামক সামাজিক অপরাধ দমনে। তবেই বাংলাদেশের জনগণ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবে এবং বাংলাদেশ হবে উন্নয়নশীল একটি রাষ্ট্র। 

খাদ্য ভেজাল ও মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম্য PDF Format 

 

অন্যান্য রচনা 
যৌতুক প্রথা / পণপ্রথা

বাংলাদেশের কৃষক
ডেঙ্গুজ্বর

Facebook
Pinterest
Reddit