boi porar anondo rochona

বই পড়ার আনন্দ 

ভূমিকা : মানুষ সামাজিক জীব। সে প্রতিনিয়ত অপরের সঙ্গ ও সান্নিধ্য কামনা করে আসছে। মানুষের সঙ্গ লাভের এ প্রবৃত্তি শুধু মানুষকে কেন্দ্র করেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। যুগ যুগ ধরে সে গ্রন্থের সঙ্গও কামনা করে আসছে। গ্রন্থের মাধ্যমে মানুষ তার আত্মার আত্মীয়ের তথা বিশ্ব মানবের সাহচর্য ও সংঘ লাভ করে। অনাদিকাল থেকেই গ্রন্থ পাঠে মানুষ অনাবিল শান্তি অনুভব করে আসছে। 

বই মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী : মানুষের শিক্ষা, সাহিত্য, সাধনা ও জ্ঞান বিজ্ঞানের নির্বাক সাক্ষী রূপে দাঁড়িয়ে রয়েছে জগতের মহামূল্যবান গ্রন্থরাজি। এগুলোর মাধ্যমে তারা লাভ করে থাকে আপন অন্তরতম সত্তার পরিচয়। নির্জন অরণ্যে যদি যাওয়া হয়, কোন মানব সঙ্গী হবে না সেই অরণ্য প্রদেশে। কিন্তু তার নিঃসঙ্গতা দূর করে দেবে একটি বই। কাউকে যদি বারো বছরের জন্য একটি অকুল সমুদ্রের জনশূন্য দ্বীপে নির্বাসন দেওয়া হয়, সেখানেও সে কোন মানুষের সঙ্গ পাবে না। কিন্তু তাতেও তার চিত্তে কোন দুঃখ অথবা গ্লানি থাকবে না, যদি সাথে থাকে বইয়ের একটি শেলফ। যদি হৃদয়ের গভীরে বিচিত্র অনুভূতির প্রকাশ চাই, তাহলে প্রয়োজন বিশিষ্ট মানুষের লেখা বিশিষ্ট কয়েকটি বই। যেমন – নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, ওয়ার্ডসওয়ার্থ কিংবা শেলীর লেখা গ্রন্থ। বিশ্বকে উপলব্ধি করতে চাইলে বইয়ের নিবিড় সঙ্গ ছাড়া মানুষের চলে না। 

বইয়ের বৈশিষ্ট্য : বইয়ের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য বই নিঃস্বার্থভাবে পাঠকের হৃদয়বৃত্তি জাগ্রত করা। এটি আনন্দ দেয় এবং মানবিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটায়। মানুষের সবচেয়ে আপন বন্ধু হচ্ছে বই। পৃথিবীতে যারা মহাজ্ঞানী মহাজনে পরিণত হয়েছে, তাদের জীবনের অভিজ্ঞতা বইয়ে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই বই থেকেই পেয়ে থাকি মূল্যবান তথ্য ও জ্ঞান। 

বই পাঠের প্রয়োজনীয়তা : বই পাঠে মানুষের মনে আসে আনন্দ-বেদনার কাব্যিক দার্শনিক সত্যবোধ। বই পাঠের মাধ্যমে মানব জীবন হয়ে ওঠে সুন্দর ও নিখুঁত। এমনকি বই পাঠই  আমাদের মনে এনে দেয় সহানুভূতি, মায়া-মমতা। ইতিহাস, রাজনীতি, অর্থনীতি ইত্যাদি বই পাঠ করে মানুষ মেটাচ্ছে তার মনের ক্ষুধা। বই পাঠ মানুষের মনকে করে উন্নত, দৃষ্টিকে করে উদার। দুঃখ-কষ্ট, হতাশা-অবসাদ, দ্বন্দ্ব-সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতে বই পাঠেই মানুষ আনন্দ উপলব্ধি করতে পারে। বই পাঠেই আমাদের হৃদয়ানন্দে সৃষ্টি হয়েছে শিল্প কথা ও সাহিত্য। সুতরাং বই পাঠের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। 

বই পাঠের আনন্দ : বই পাঠ আনন্দ লাভের শ্রেষ্ঠ পথ। বই মানুষকে দেয় অনাবিল আনন্দ। মানুষের উচ্চতর বৃত্তিগুলোর জন্য চাই সত্য, জ্ঞান ও আনন্দের আলো। একমাত্র বই তার চাহিদা পূরণে সক্ষম। বই পাঠে আনন্দ অনুভব করে ওমর খৈয়াম বলেছিলেন- “রুটি-মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্তযৌবনা- যদি তেমন বই হয়।” বই পাঠেই মানুষের কর্ম ক্লান্তি দিনের ব্যস্ততা দূর করে এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি। এটি মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে কাজ করে। জীবনের অভিঘাত আমাদেরকে যখন হতাশায় পরিণত করে তখন আমরা সান্তনা, সহানুভূতি এবং আনন্দের জন্য ছুটি বই পাঠের দিকে। আর এই বই-ই দুঃখ বেদনায় এনে দেয় বিশুদ্ধ মত্ততা।  

বই ও মানবজীবন : বই পাঠের মাধ্যমে আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারছি এমনকি আমাদের চিত্তকে সত্য, সুন্দর আনন্দময় অনুভূতিতে পরিপূর্ণ করতে পারি। বই পাঠের মাধ্যমে মনুষ্যত্বহীন মানুষ ফিরে পায় তার মনুষ্যত্ব। তাছাড়া বই পাঠে একজন ব্যক্তি নতুন রূপে নতুনভাবে জন্মগ্রহণ করতে পারে। বই আমাদেরকে সঠিক পথের দিকনির্দেশনা দেয়। বই পাঠের মাধ্যমে মানুষ ভালো-মন্দ ও সত্য-মিথ্যা বুঝতে পারে। তাছাড়া বই পড়ার মাধ্যমে আমরা ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারি। তাই এ কথা বলা যায় যে, বই ও মানব জীবন একে অপরের সাথে ওতোপ্রোতোভাবে মিশে আছে।  

বই পড়ার সময় নির্বাচন : সব সময় বই পড়ে একই ধরনের আনন্দ উপলব্ধি করা যায় না। কেননা বই পড়ার আনন্দ অনেক সময় নির্ভর করে পরিবেশ, পরিস্থিতি ও পারিপার্শ্বিকতার উপর। তাই বই পড়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজন রয়েছে। কোনো নির্জন জায়গায় বসে একটি বই পাঠ করলে যে আনন্দ উপভোগ করা যায়, কোনো ব্যস্ত জায়গায় ওই বইটি পাঠ করলে সেই আনন্দ পাওয়া যায় না। আবার অনেকে আছে ভ্রমণের সময় বই পড়ে অনেক আনন্দ উপভোগ করে। অর্থাৎ যে সময় যে বইটি পড়ে আনন্দ অনুভব করা যাবে, সে সময় সেই বইটি পড়তে হবে। আর বই পড়ার জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় নির্বাচন করতে হবে।

আনন্দের বিশেষত্ব : ব্যক্তিমন সমাজ এবং সভ্যতাকে লালন করেই বেঁচে ওঠে। সমসাময়িক সময়ের নানাবিধ সংগতি ব্যক্তিমনকে প্রভাবিত করে। আর এই ব্যক্তিমনের যথার্থ বিকাশ ঘটে বই পড়ার ফলে। বই পাঠের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে দেশ বিদেশের নানাজনের নানা চিন্তাচেতনা, সত্যের অনুসন্ধান এবং উন্নত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন  ঘটানোর শিক্ষা। আর এখানেই ফুটে উঠেছে বই পড়ার আনন্দের বিশেষত্ব।  

বইপড়া আত্মোপলব্ধির উপায় : পৃথিবীর সমস্ত কালের সমস্ত সাহিত্যেই কোনো না কোনো দেশ, কাল ও সমাজবাস্তবতার প্রেক্ষাপটে রচিত। নানাবিধ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার সংমিশ্রণে এসব সাহিত্য সমৃদ্ধ, সাহিত্য পাঠে একজন স্বাভাবিক মানুষ অপরিসীম চিন্তা-চেতনা ও ভাব-কল্পনার অধিকারী হতে পারে। এমনকি সে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতা লাভ করে। তার ভেতরে সৃষ্টি হয় এক ধরনের আত্মোপলব্ধি।

বই ও আধুনিক সভ্যতা : বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার আমাদের সভ্যতাকে করেছে গতিময়। ভোগবিলাসের উপকরণ প্রাচুর্যের হাতছানিতে মানুষ দিশেহারা। এই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কর্মব্যস্ত পরিবেশে বই পাঠের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোচনা এসেছে। ব্যবহারিক জীবনে এর উপযোগিতা নিয়ে সংশয় জেগেছে। কারণ, বই পড়া কিংবা বই লেখার জন্য চাই অবকাশ। কিন্তু মানুষ এখন ব্যস্ততার কারণে হারিয়ে ফেলছে তার অবসর সময়। আধুনিক সভ্যতার যুগে এসেও শত শত বাধার মধ্যেও বই আমাদেরকে এনে দেয় আনন্দের অফুরন্ত ধারা। এখনও জগতের কবি-সাহিত্যিকগণ মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। কেননা তারা আজও মানুষের জন্য রচনা করে চলেছেন সুন্দর বই। 

মনের স্বাস্থ্যবিধানে বই পড়া : দেহ ও মন মিলিয়ে একজন মানুষ পরিপূর্ণ হয়। দেহের পুষ্টির জন্য প্রয়োজন খাদ্য, আর প্রয়োজন সেই খাদ্য সংগ্রহের নিরন্তর চেষ্টা। তেমনি মনের স্বাস্থ্যের জন্য দরকার মানসিক খাদ্য। দেহ গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য চারপাশ থেকে আমরা সহজেই পেতে পারি কিন্তু মন গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য আমরা এত সহজে পেতে পারি না। সেই খাদ্য জমা থাকে বইয়ের পাতায়। বই পড়ার মাধ্যমে আমাদের মনে আসে এক সুখের তৃপ্তি, এটি মনকে সর্বদা প্রফুল্ল রাখে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ও মনের স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য আমাদের বই পড়ার কোন বিকল্প নেই।  

জ্ঞানভান্ডার : বই হলো শ্রেষ্ঠ জ্ঞানের ভান্ডার। মানবের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটে পুস্তক পাঠের মাধ্যমে যা পরবর্তীকালে জ্ঞানের বিষয় আখ্যা  পায়। পুস্তক পাঠ ছাড়া কোন মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে না। কারণ মানুষের জন্ম সবকিছু জেনে-শুনে হয় না। মানুষ বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে পারে বই পাঠ করার মাধ্যমে। 

ভৌগোলিক জ্ঞান লাভ : পৃথিবীতে আমরা সবকিছু জেনে শুনে জন্মগ্রহণ করি না। এমনকি পৃথিবীর সবকিছু অনায়াসে আমাদের চোখের সামনে হাজির হয় না। শুধুমাত্র আমরা পুস্তক পাঠ করার মাধ্যমে বিশ্বের ভৌগোলিক অবস্থান, সীমারেখা, জলবায়ু, জাতি, ভাষা, প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে পারি। 

আত্মোন্নয়নের সহায়ক : আমাদের আত্মার উন্নয়ন ঘটে পুস্তক পাঠের মাধ্যমে। বই আমাদের মনের সকল জড়তা সংশয় দূর করে মনের জগৎকে আলোকিত করে তোলে।

প্রকৃত মানুষ হতে সাহায্য করে : আমাদের সকলের জীবনে নানা ধরনের ভুলভ্রান্তি থাকে। আর এই ভুলভ্রান্তি দূর করা যায় বই পাঠের মাধ্যমে। কারণ বই থেকে জ্ঞান অর্জন করে মানুষ নিজেকে সংশোধন করতে পারে। যাতে করে একজন মানুষ প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। 

মানবতাবাদী হতে শিক্ষা দেয় : পুস্তক পাঠের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব। এমন কোন জ্ঞানের বিষয় নেই, যা বইয়ের পাতায় স্থান পায়নি। তাই বই পাঠের মাধ্যমে মানুষ হয়ে ওঠে মানবতাবাদী। 

উপসংহার : মানুষের মৌলিক চাহিদা হলো পাঁচটি, তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। আর এই শিক্ষা গ্রহণের উপযুক্ত স্থান হচ্ছে বই । এই বই-ই পারে মানুষের মনের খোরাক যোগাতে। দেশের উন্নতি, জ্ঞানের পরিধি বৃদ্ধি এবং শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে বইয়ের গুরুত্ব অতুলনীয়। তাই বইয়ের পরিধি ও প্রসার ঘটাতে হবে। 

বই পড়ার আনন্দ PDF Format

 

অন্যান্য রচনা 
ডেঙ্গুজ্বর
খাদ্য ভেজাল ও মুনাফালোভীদের দৌরাত্ম্য
শহীদ তিতুমীর

 

Facebook
Pinterest
Reddit