অথবা, জনসেবা জনভাবনা: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ
ভূমিকা :
“আপনারে লয়ে বিব্রত রোহিতে
আসে নাই কেহ অবনী পরে
সকলের তরে সকলে আমরা
প্রত্যেকে মোরা পরের তরে।”
–কামিনী রায়
মানবজীবনের সার্থকতা ফুটে ওঠে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার মাধ্যমে। মানুষ একে অন্যের সাথে মিলেমিশে বসবাস করে। তাই অপরের সাহায্য ছাড়া জীবনধারণ অসম্ভব। অপরের কল্যাণে সেবা এবং সহযোগিতায় আত্মত্যাগের ব্রতের নামই হলো জনসেবা। আদিম সমাজ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানব সভ্যতার যে ক্রমবিকাশ তার মূলে রয়েছে অন্যের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা। অপরের দুঃখ-কষ্ট আনন্দ-বেদনার সাক্ষী হতে পারার মাঝেই জনসেবার অনুপ্রেরণা পাওয়া যায়। জনসেবাই মানুষকে মহৎ মানুষের রূপান্তরিত করে।
জনসেবা : জনগণের সেবাই হলো জনসেবা। কিন্তু এর মাঝে রয়েছে মহৎপ্রাণ মানসিকতা। সমাজের বৃহৎ অংশের জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধনের জন্য কর্ম পরিচালনা ও ভূমিকা পালন করার নামই হলো জনসেবা।
জনসেবার ধারণা কেবল দুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। মানব কল্যাণের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনই হলো জনসেবা। আবার,অনেকে মানব কল্যাণ বলতে জনসেবাকেই বুঝিয়ে থাকেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব-কর্তব্য পালনকেও একই অর্থে নেন। কিন্তু বর্তমান সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জনের লক্ষ্যে, মানুষের মন জয় করার জন্য শুধু নিজের নির্বাচনী এলাকায় রাস্তাঘাট মেরামত, সেতু নির্মাণ, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। যার পেছনে লুকিয়ে থাকে ব্যক্তিস্বার্থ। এজন্য এগুলো সত্যিকারের জনসেবা নয়। জনসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তির মধ্যে প্রতিফলিত হয় উন্নত আদর্শ। সেই আদর্শের স্পর্শে জনগণের কল্যাণ সাধন হয়। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থকে পরিত্যাগ করে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র জনগণের কল্যাণ বা সেবাই হলো জনসেবা।
জনসেবার প্রাচীন ঐতিহ্য : বহু যুগ আগে থেকেই পরহিতের ধারণা মানুষের সমাজে বিরাজ করছে। প্রথমে ধর্মীয় চেতনা দ্বারাই মানুষ সেবা ব্রতে নিয়োজিত হয়েছে। সব ধর্মীয় শাস্ত্রে জনসেবাকেই মানুষের প্রধান কর্ম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। মানুষের কল্যাণ না করে কেউ ধর্ম বা সত্যের পথে থাকতে পারে না। যুগে যুগে মহামানবগণ আদর্শকে প্রচার করে গেছেন। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) বলেছেন “সকল কাজের মধ্যে সমাজকল্যাণের কাজই শ্রেষ্ঠ”। অন্যদিকে বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ তিনি নিজের জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন মানুষের দুঃখ-কষ্ট দূর করার মহান ব্রতে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেছেন, “শিবঙ্গানে জীবসেবা কর”। যীশুকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল মানুষের মুক্তির বাণী প্রচার করতে গিয়ে। জগতের প্রত্যেক সৎ ও নির্ভীক ধর্মগুরু মানুষকেই সকল চিন্তার কেন্দ্রে রেখেছিলেন এবং মানুষের কল্যাণ চিন্তাই ছিল তাদের ধর্ম সাধনের মুলতন্ত্র।
আধুনিক সমাজে জনসেবা : অপরের উপকারের মধ্যেই সেবা ধর্মের মাহাত্ম্য লুকানো আছে। পরিবর্তনের ধারায় মানুষের মধ্যে পরোপকারের ধারণারও পরিবর্তন ঘটে। কেননা প্রতিনিয়ত সমাজ পরিবর্তিত হচ্ছে। আধুনিক যুগে এসেও আমাদের কাছে জনসেবার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে সারা পৃথিবী বহু দেশ ও জাতিতে বিভক্ত। সকল দেশ ও জাতির সমস্যা একই রকম নয়। কেননা, সেখানকার মানুষের দুঃখ কষ্ট বেদনা ও দুর্দশার চিত্র হয়তো অন্যদের বা ভূখণ্ডের মানুষের মতো নয়। তবুও জনসেবার ধারণা সর্বত্রই বর্তমান। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মানুষের শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য দরকার সহযোগিতা, এটিও এক প্রকার জনসেবা। আধুনিক সমাজে বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানুষের জীবনকে সহজ করেছে। কিন্তু এই সুযোগ-সুবিধা থেকে যারা বঞ্চিত হয়ে মানববেতর জীবনযাপন করছে, অবশ্যই তাদের পাশে জনসেবার উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়াতে হবে। বিশ্বের নানা প্রান্তে এখন যুদ্ধ, জঙ্গি তৎপরতা, অস্ত্র ব্যবসা, গোপন অভিযান ইত্যাদি এক অস্থিরতা বিরাজ করছে। এগুলোর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সমাজসেবার মহান ব্রত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও জনসেবা : জগতের বুকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ স্বমহিমায় উজ্জ্বল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। অনেক লড়াই সংগ্রাম পেরিয়ে বাংলাদেশ আজ বর্তমান অবস্থায় উপনীত হয়েছে। কিন্তু এদেশ যতটুকু উন্নত এবং সমৃদ্ধ হতে পারতো তা এখনো সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা আজও দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। অনাহারে-অর্ধাহারে থেকে অনেকে মৃত্যুবরণ করছে এরকম খবর প্রায়ই পত্রিকায় আসে। বাংলাদেশের বেশিরভাগ জনসংখ্যা স্থায়ী বাসস্থানের অভাবে ভুগছে। অধিকাংশ ফুটপাতে জীবনযাপন করছে, আবার অনেকে ভ্রাম্যমান হয়ে বস্তিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এসব মানুষ কিন্তু দেশের নাগরিক। এদেরকে অবহেলায় রেখে দেশ ও জাতির সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ সম্ভব নয়।
সামাজিক দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে ব্যক্তি মানুষের ভূমিকা অপরিসীম। কিন্তু জনসেবার জন্য যাদের নিয়োজিত থাকার কথা, আজ তারাই দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যক্তিস্বার্থ, চরিতার্থ করায় ব্যস্ত। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎকে আলোকিত করার জন্য সত্যিকারের জনদরদি সেবকের প্রয়োজন।
জনসেবায় ছাত্র সমাজের ভূমিকা : ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই সমাজের উন্নতি ও সেবায় ছাত্রদের অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশের অতীত ও ঐতিহ্য সেই ভূমিকার সাক্ষী। জনসেবামূলক কর্মকান্ডে ছাত্র সমাজে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখতে পারে। পড়ালেখার পাশাপাশি সাধারণ জনগণের মধ্যে শিক্ষাদান, শীতবস্ত্র বিতরণ, অসুস্থ মানুষের চিকিৎসা সম্মিলিত সহায়তা কর্মসূচি ইত্যাদি সেবামূলক কর্মে ছাত্রসমাজ এগিয়ে আসতে পারে। একটি দেশের ছাত্র সমাজ সেদেশের ভবিষ্যৎ। তাই সেবামূলক নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনার মধ্য দিয়ে মূলত তারা দেশকে পরিচালনা করতে পারে।
জনসেবা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান : একটি দেশের উন্নতি বলতে বোঝায় সেই দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। আর এই অর্থনীতি পরিচালনার মূল দায়িত্বটি থাকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান বা দল গুলোর উপর। ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর উপর জনসেবার মূল দায়িত্বটি থাকে। বিরোধী দলগুলো ক্ষমতাসীন দলগুলোর কার্যক্রমের অসংগতি বা ঘাটতি জনগণের সামনে তুলে ধরে। যার ফলে জনসেবার কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ সচেতন থাকে।
তবে আমাদের দেশে প্রচলিত রাজনৈতিক কার্যক্রম জনসেবার জন্য অনুকূল নয়। ক্ষমতাসীন দলগুলো জোরপূর্বক টিকে থাকার চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে অতি লোভ, দুর্নীতি, লুটপাট, পারস্পারিক অসহিষ্ণুতা ভয়ানকভাবে পরিলক্ষিত হয়, যা রাজনৈতিক পরিবেশ কে করে কুলুষিত। তাদের মূল কাজ জনসেবা কে পাস কাটিয়ে ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার দিকে অধিক মনোযোগী থাকে। এর ফলে দেশে চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ এবং জনসাধারণকে সীমাহীন দুর্ভোগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়।
জনসেবা ও সেবা প্রতিষ্ঠান : দেশের জনসেবায় এগিয়ে আশার জন্য ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগতভাবে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান কাজ করে থাকে। তারা সর্বদা চেষ্টা করে দুর্গত, বিপন্ন মানুষের পাশে সেবার হাত বাড়িয়ে দিতে। রাজনৈতিক দলীয় মনোভাবের বাইরে এই প্রতিষ্ঠানসমূহ যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তা অতুলনীয়।
উপসংহার : মানুষ এই পৃথিবীতে একমাত্র মনুষ্যত্বের জোরেই এত গুরুত্বপূর্ণ আসনে অধিষ্ঠিত। পরিহিত কল্যাণ ও জনসেবার মাধ্যমেই সেই মনুষ্যত্বের পূর্ণ প্রকাশ। নিজস্বার্থকে উপেক্ষা করে সকলের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা একটি মহৎ গুণ। এই মহৎ গুণের অধিকারী ব্যক্তিরা জনসেবার মহান ব্রত ব্রতী হলেই দেশ ও সমাজ এগিয়ে যাবে উন্নতির স্বর্ণশিখরে। কলুষিত পথে যারা চলছে সে পথকে পরিহার করে সত্যিকার জনসেবায় মন দিয়ে, আজ আমাদের সকলের এগিয়ে আসতে হবে। সেটাই হবে জনসেবা, আর গড়ে উঠবে একটি সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
অন্যান্য রচনা
বই পড়ার আনন্দ
প্রিয় কবি (কাজী নজরুল ইসলাম)
বাংলাদেশের উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তির ভূমিকা