porjoton shilpo rochona

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প 

ভূমিকা : মানুষের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের আকাঙ্ক্ষা তাকে নিয়ে যায় হিমালয় থেকে সুন্দরবন, পিরামিডের চূড়া থেকে টেমস নদীর তীরে। বৈচিত্র পিয়াসী মানুষ চাঁদের দেশে পা বাড়ায়, সমুদ্রের বালুতটে ঢেউয়ের সৌন্দর্যে রুদ্র স্নান করে। অজানাকে জানার, অদেখাকে দেখার প্রবল বাসনা, প্রকৃতির রহস্য ও বৈচিত্র্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে। তাই সে ছুটে যাই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে। পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমণ করে জানার কৌতূহল মেটায়। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য মনমুগ্ধকর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি দৃষ্টিনন্দন সম্পন্ন জীবনাচার বাংলাদেশকে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণীয় পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছে। 

পর্যটন শিল্প কী : পর্যটন একটি বহুমাত্রিক ও শ্রম ঘন শিল্প। সবচেয়ে দ্রুত সম্প্রসারণশীল ও বৃহৎবাণিজ্যিক কাজকর্ম হিসেবে এ শিল্প নিজস্ব গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করেছে। মূলত মানুষ অজানাকে জানার ব্যাকুলতায় ভ্রমণ করে। এটি জীবনের ধর্ম প্রাণশক্তির পরিচায়ক। মানুষের এ ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষা থেকেই পর্যটন শিল্পের উৎপত্তি। পৃথিবীর অনেক দেশে এ পর্যটন শিল্প আজ এক নতুন রূপ পরিগ্রহ করেছে। আশীর্বাদে দূরত্ব বর্তমানে মানুষের জীবনে কোন সমস্যা নয়। এজন্য পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশও এ অগ্রযাত্রায় পেছনে পড়ে নেই। 

বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের উপায় : বহু সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের বাংলাদেশ। বাংলাদেশের চারপাশে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য নদ-নদী, ম্যানগ্রোভ বন, ইকোপার্ক, পাহাড়ি সৌন্দর্য, বিশাল সমুদ্র; যা একটি পর্যটন শিল্পের জন্য খুবই প্রয়োজন। পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে অনেক উন্নয়নশীল দেশ উন্নতি লাভ করেছে। আবার এমনও দেখা গেছে, যে সকল দেশের শুধু ছোট বনাঞ্চল বা ছোট সমুদ্র এলাকা রয়েছে তা দিয়েই অনেক পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটাচ্ছে। 

পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে একটা দেশের রাজস্ব ও জিডিপি বাড়ে। প্রাথমিকভাবে পর্যটন শিল্পের অবকাঠামোর জন্য প্রচুর বিনিয়োগের দরকার হয়। এই শিল্পের মাধ্যমে স্থানীয় লোকজনের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হয়। পর্যটন শিল্প একটি সেবামূলক শিল্প। পর্যটন নিয়ে আমাদের ব্রান্ড নেম ‘বিউটিফুল বাংলাদেশ’। ইতিমধ্যে এটি সারাবিশ্বে বেশ পরিচিতি লাভ করেছে। যা বৈশ্বিক মুদ্রা উপার্জনে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে। 

বাংলাদেশের পর্যটন ব্যবস্থা : বাংলাদেশ সরকার পর্যটন শিল্পের ব্যাপারে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হাতে দেশের পর্যটন শিল্পের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে এবং পর্যটন শিল্পকে ব্যাপক ও আকর্ষণীয় করার উদ্দেশ্যে ইতোমধ্যেই নানাবিধ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আসার কথা হলো, সমগ্র বাংলাদেশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পর্যটন উপযোগী অসংখ্য দুর্লভ ও সুন্দর স্থান। এছাড়া মহাস্থানগড়, সোমপুর বিহার, ময়নামতি ইত্যাদি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান। 

বাংলাদেশের দর্শনীয় স্থান : চিরসবুজ এই বাংলাকে কেউ বলেছেন স্বর্গের দরজা, আবার কেউ বলেছেন সোনার বাংলা। সত্যি এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যে কোন মানুষকেই মুগ্ধ করার মতো। ময়নামতির বৌদ্ধ বিহার আমাদের বৌদ্ধ সভ্যতার কথা মনে করিয়ে দেয়। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত (১৫৫ কি.মি.) কক্সবাজারে অবস্থিত। হিমছড়ির শীতল পানির ঝরনা, সবুজে ঘেরা মাধবকুণ্ডের দীর্ঘ জলপ্রপাত আমাদের তথা পর্যটকদের মুগ্ধ করে তোলে। সিলেটের মনোমুগ্ধকর চা বাগান,জাফলং-এর প্রাকৃতিক অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ্য। কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য সকলকে আকৃষ্ট করে। সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের লোক শিল্প জাদুঘর, পৃথিবীর একমাত্র ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন ও এর রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতল হরিণ ইত্যাদি পর্যটকদের মুগ্ধ করে। ঢাকায় আহসান মঞ্জিল একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান। এছাড়া মহাস্থানগড়, সোমপুর বিহার, ময়নামতি প্রভৃতি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান।

পর্যটকদের জন্য সুযোগ-সুবিধা : পর্যটন বিষয়ে জানার জন্য বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের বিভিন্ন শাখা-অফিস দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে স্থাপন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন অংশে পর্যটকদের থাকার জন্য আধুনিক ডাকবাংলো স্থাপিত হয়েছে। এছাড়া পর্যটকদের জন্য কাপ্তাইয়ে ও রাঙ্গামাটিতে কতকগুলো সুন্দর ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। দেশি ও বিদেশী পর্যটক এখানে ভিড় করে থাকেন। কক্সবাজারে সমুদ্র তীরের কাছে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের অত্যাধুনিক হোটেল ও মোটেল এবং থাকা খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। সর্বোপরি, সমুদ্রস্নান ও স্পিডবোট এবং খোলা জীপে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার সুযোগ আছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর মানসপ্রিয়াকে বলেছেন, “অর্ধেক মানবী তুমি অর্ধেক কল্পনা”। সাগর কন্যা বাংলাকেও আমরা একই কথা বলতে পারি। কারণ ইতিহাস প্রসিদ্ধ এসব স্থানগুলো যুগ যুগ ধরে পর্যটকদের মনে বিশেষ কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। 

সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ : পর্যটন শিল্পকে জনপ্রিয় ও ব্যাপক করার জন্য সরকারের প্রথম পদক্ষেপ হলো পর্যটন কর্পোরেশন গঠন। বিদেশি পর্যটকদের এদের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের জন্য এর সংস্থা নানা প্রকার উপায় অবলম্বন করেছে। পর্যটন শিল্পকে আধুনিক ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। পর্যটন কর্পোরেশনও এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে অর্থনৈতিক দীনতাই এক্ষেত্রে আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রয়োজন অত্যন্ত বেশি। আর এ প্রয়োজন মেটাতে হলে পর্যটন শিল্পকে অবশ্যই লাভজনক করতে হবে। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার তা হলো – গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমৃদ্ধি স্থান সমূহে বিলাসবহুল প্রমোদকেন্দ্র, ক্রিয়াকেন্দ্র এবং অভিজাত শ্রেণীর হোটেল স্থাপন করা। আর সেই সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। 

বেসরকারি উদ্যোগ : আমাদের দেশে সরকারের পাশাপাশি কিছু বেসরকারি সংস্থা পর্যটনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন প্যাকেজ ট্যুরের আওতায় দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে বেড়াবার সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনকি গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় বিনোদন কেন্দ্র। 

পর্যটনশিল্পের সমস্যা : বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে রয়েছে একাধিক সমস্যা। সমস্যাগুলো অক্টোপাসের মতো ঘিরে আছে পর্যটন শিল্পকে। যেমন : 

ক) অবকাঠামোগত দুর্বলতা : অবকাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প মারাত্মক সমস্যায় জর্জরিত। সংকীর্ণ রাস্তাঘাট, যানজট, পুরোনো পদ্ধতির যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিরাপদ আবাসনব্যবস্থার অভাব যা বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করতে পারছে না। 

খ) রাজনৈতিক অস্থিরতা : রাজনৈতিক অস্থিরতা বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের বিকাশে মারাত্মক অন্তরায়। ১৯৭৫ সালের পর থেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ায় অদ্যাবধি হরতাল-অবরোধ-ভাঙচুর লেগেই আছে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যেমন এদেশের বিনিয়োগ উৎসাহবোধ করছে না, তেমনি এ দেশের ভ্রমণে আসতে উৎসাহ পাচ্ছে না বিদেশি পর্যটকরা। 

গ) উন্নত সেবা ও তথ্যের অভাব : বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে উন্নত সেবা ও তথ্যের অভাব বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে দক্ষ,শিক্ষিত মার্জিত জনবলের অভাব যেমন প্রকট,তেমনি রয়েছে উন্নত সেবার অভাব।

ঘ) সামাজিক সমস্যা : বিদেশি পর্যটকদের সংস্কৃতিকে এদেশের অনেকেই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তাদের সম্পর্কে অনেকেই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করে এবং আচরণের বেলায়ও তাই দেখা যায়। এটা পর্যটন শিল্পের বিকাশের অন্তরায়। 

ঙ) অতিরিক্ত ব্যয় : অতিরিক্ত ব্যয়ভারের জন্য দেশের পর্যটনের প্রতি ভ্রমণ পিপাসুদের আগ্রহ কমে আসছে। বন বিভাগ সুন্দরবনের আসা পর্যটকদের জন্য পর্যটন চার্জ দ্বিগুণ করেছে। এসব কারণে দেশি-বিদেশি পর্যটকরা পর্যটন শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। 

উপসংহার : বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের অর্থনীতিতে পর্যটন শিল্প এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এ শিল্পের ভবিষ্যৎ অনেক সম্ভাবনাময়; প্রয়োজন শুধু সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ। আশা করি,সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় আগামীতে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হবে

বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প  রচনা PDF Format

অন্যান্য রচনা
যৌন নিপীড়ন : এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচনা
আমি সুনাগরিক হতে চাই

Facebook
Pinterest
Reddit