ভূমিকা : মানবসভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো পরিবেশ। মানুষ সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকে তার পরিবেশ গড়ে তুলেছে। আদিম পাথরের যুগ থেকে বর্তমান সভ্যতার শীর্ষে উঠেছে মানুষ তার কর্মের ফলে। এ কর্ম মানুষের জন্য যেমন বয়ে এনেছে সুফল, তেমনি দিয়েছে কুফল। মানব সভ্যতা তাদের নিজ নিজ প্রয়োজনে এ পরিবেশকে ব্যবহার করছে বটে কিন্তু তা কতটা সুফল যোগ্য এটা বিচার করতে গেলে নানারকম সমস্যা ধরা পড়ে। সভ্যতা যেন তার কর্মদোষ, বর্তমান এক ভয়ংকর মুহূর্তের সামনে দাঁড়িয়ে। পরিবেশের উপর নানারকম প্রভাব পড়ছে। পরিবেশ হচ্ছে দূষিত, আর সভ্যতা দাঁড়িয়ে হুমকির মুখে। এ বিষয়টি যেন আজ বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত।
পরিবেশ কী : সাধারণভাবে বলতে গেলে পরিবেশ হলো আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে মূলত তা-ই পরিবেশ। পরিবেশ যা আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। জীববৈচিত্র্য কেমন হবে, তা একমাত্র নির্ভর করে পরিবেশের উপর। পরিবেশ আমাদের নিয়ন্ত্রণকর্তা। এ বিষয়টির উপর নির্ভর করে বলা যায়, আমাদের চারপাশে যে সকল উপাদান আছে, যা সমস্ত জীবের শারীরিক ও মানসিক দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করে আর বসবাস ও কাজের পরিধি তৈরি করে, তা-ই পরিবেশ। এজন্য পরিবেশ সংরক্ষণ আমাদের সকলের গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস : বিশ্বের সবচেয়ে বড় সংস্থা জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত দিবস হলো পরিবেশ দিবস। দিবসটি প্রত্যেক বছর ৫ই জুন বিশ্বব্যাপী পালিত হয়। মূলত এ দিবসটি পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো বিশ্বব্যাপী পরিবেশ সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং উন্নত বিশ্বের দিকে দৃষ্টি দেওয়া। কেননা পরিবেশ দূষণে উন্নত বিশ্বের দেশসমূহের কর্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া সকল দেশের মানুষ যেন পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখতে পারে, তা নিশ্চিত করা।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের উদ্যোগ : বিশ্ব পরিবেশ দিবস বিশ্বব্যাপী World Environment Day বা WED নামে জনপ্রিয়। ১৯৭২ সালে জাতিসংঘের মানবিক পরিবেশ কনফারেন্সে বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগ আর জনসচেতনতার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ৫ই জুন তারিখকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এরপর ১৯৭৩ সালে সারাবিশ্বে সর্বপ্রথম দিবসটি পালন করা হয়। প্রতিবছর ৫ই জুন দিবসটিকে ঘিরে জাতিসংঘসহ বিশ্বের সকল দেশে নানারকম কর্মসূচি গ্রহণ ও পালন করা হয়। দিবসটি উত্তর গোলার্ধে বসন্তে আর দক্ষিণ গোলার্ধে শরৎকালে পালিত হয়।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের স্লোগানসমূহ : বিশ্ব পরিবেশ দিবস বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশ নানারকম কর্মসূচি গ্রহণ করে। এ সময় তারা নানারকম স্লোগান দিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে সচেষ্ট থাকেন। বাংলাদেশের গত পাঁচ বছরে বিশ্ব পরিবেশ দিবসে যে স্লোগানগুলো ব্যবহার হয়েছে তা দেখলেই এ দিবসের তাৎপর্য উপলব্ধির সহজ হয়। বাংলাদেশের বিশ্ব পরিবেশ দিবস উপলক্ষে গত পাঁচ বছরের স্লোগান গুলো হলো –
১. ২০১১ সাল : Forest Nature at your service.
২. ২০১২ সাল : পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে আপনিও গর্বিত অংশীদার হোন।
৩. ২০১৩ সাল : ভেবেচিন্তে খায়, অপচয় কমাই।
৪: ২০১৪ সাল : হতে হবে সোচ্চার, সাগরে উচ্চতা বাড়াবো না আর।
৫. ২০১৫ সাল : শতকোটি জনের অপার স্বপ্ন, একটি বিশ্ব করিও না নিঃস্ব।
উপরোক্ত স্লোগান থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, পরিবেশকে বাঁচাতে এ দিবসের গুরুত্ব কতটা তাৎপর্যপূর্ণ।
বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালনের উদ্দেশ্য : সারা বিশ্বে মানুষ, প্রকৃতি ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং বসবাসযোগ্য একটি পৃথিবী গড়ার মহান অঙ্গীকার নিয়েই পালিত হয় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। পৃথিবী টিকে আছে তার আশপাশের পরিবেশের উপর নির্ভর করে। কিন্তু মানুষ সভ্যতার বিকাশ সাধনে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে ইচ্ছা বা অনিচ্ছাকৃতভাবে। মাটি, পানি, বায়ুকে দূষিত করছে। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ প্রতিনিয়ত ঘটছে নানা রকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা মুহূর্তের মধ্যেই সাজানো-গোছানো জনপদকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। তাছাড়া বন উজাড় করছে, বন্যপ্রাণী নিধন করছে, পাহাড় কাটছে, পানিতে নানা রকম রাসায়নিক ব্যবহার করছে, বায়ুতে কলকারখানার বিষাক্ত পদার্থ নির্গত করছে, মাটিতে রাসায়নিক সার ব্যবহার করে খাদ্যের গুণগতমান নষ্ট করছে। এরূপ হাজারো সমস্যায় পৃথিবী আজ মারাত্মক হুমকির মুখে। এ সমস্যা সমাধানে সবার প্রথমে প্রয়োজন জনসচেতনতা বৃদ্ধি। আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস এ লক্ষ্যেই পালন করা হয়।
মানব জীবনে পরিবেশের প্রভাব : পরিবেশের সাথে মানবজীবনের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। পরিবেশই মানব জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। পরিবেশ সুস্থ স্বাভাবিক ও সুন্দর থাকলে, তবে মানব জীবনেরও সুস্থ বিকাশ নিশ্চিত হয়। তাই পরিবেশকে সুন্দর রাখা মানুষের অন্যতম একটি দায়িত্ব। সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে মানুষ তার ইচ্ছামত ব্যবহার করছে এ পরিবেশকে। এতে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পরছে কি না, তা কেউ কখনো লক্ষ্য করেনি। এমন অসচেতনতার জন্য পরিবেশ যেন আজ ধ্বংসের মুখোমুখি। বায়ুতে কার্বনডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, হঠাৎ করে জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরিমাণ বৃদ্ধি-এ সকল সমস্যাগুলো একদিনের নয়। মূলত এগুলো হলো দীর্ঘদিনের কর্মফল, যা মানবসভ্যতাকে আজ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। তাই এ বিষয়ে জনমত তৈরি করা যেন সময়ের দাবি।
পরিবেশদূষণের কারণ : মাটি, পানি, বায়ু এ তিনটি পরিবেশের প্রধান উপাদান। এগুলো দূষিত হচ্ছে বলেই পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। তাছাড়া পরিবেশ দূষণের একাধিক কারণ রয়েছে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো —
১. অপরিকল্পিতভাবে বাসগৃহ নির্মাণ, শিল্পকারকানা স্থাপন, যানবাহন চালানো ইত্যাদি নানা কর্মকাণ্ডের ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।
২. অপরিকল্পিতভাবে বৃক্ষ নিধন, পাহাড় কাটা, বন্যপ্রাণী ধ্বংস করা পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ।
৩. খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ফসলের জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে নানা ধরনের কীটনাশক ও রাসায়নিক সার, যা বৃষ্টির পানির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে নানা স্থানে। এতে পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে।
৪. পলিথিন ব্যবহার, যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা, নদীর পানিতে বর্জ্য ফেলার কারণে পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে।
৫. মাত্রাতিরিক্ত গ্রীন হাউজ প্রক্রিয়ার ফলে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি বয়ে আনছে বলে পরিবেশবিদদের ধারণা।
৬. উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহারসহ নানা রকম আগ্নেয় অস্ত্রের ব্যবহারের ফলে পরিবেশ দূষণের শিকার হচ্ছে।
৭. প্রতিনিয়ত বাস, ট্রাক, ট্রেন, বিমান ইত্যাদি ভারী যানবাহন চলাচলের ফলে এর কালো ধোঁয়া ও বিকট শব্দে পরিবেশকে দূষিত করছে।
৮. নৌপথে অতিরিক্ত নৌযান চলাচলে নদীর পানি দূষিত হচ্ছে।
পরিবেশ রক্ষায় করণীয় : পরিবেশ আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রধান উপাদান। তাই পরিবেশকে রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। এর জন্য বহুমুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। নিম্নে তা তুলে ধরা হলো –
১. মোটরগাড়ি সহ সকল প্রকার যানবাহনের কালো ধোঁয়া দূরীকরণে পদক্ষেপ নেওয়া।
২. বেশি বেশি বৃক্ষরোপন, জীববৈচিত্র সংরক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৩. কলকারখানাগুলোর নির্গত ধোঁয়া, রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার বন্ধ করা।
৪. নির্দিষ্ট স্থানে ময়লা ফেলা এবং নদীকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা।
৫. বিজ্ঞানের কুফল গুলো যথাযথভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা নিবারণে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৬. পরিবেশ সংরক্ষণে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সহযোগিতা বৃদ্ধি করা।
৭. মাটি, পানি, বায়ু দূষণ রোধে কাজ করা।
৮. সর্বোপরি এ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য রাজনৈতিক কর্মোদ্যম বৃদ্ধি করা।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসের ভূমিকা : পরিবেশ সংরক্ষণ ও মানোন্নয়নের লক্ষ্যে সারা বিশ্বে পালিত হয় ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। দিবসটি উপলক্ষে জাতিসংঘসহ বিশ্বের সকল সদস্য দেশে নানারকম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। দিবসটিকে উদ্দেশ্য করে নানা রকম স্লোগানও দেওয়া হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কাজ থেকে বিরত রাখার জন্য গড়ে তোলা হয় জনমত। বিশ্বের প্রতিটি দেশে রাজনৈতিক কর্মোদ্যোগসহ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ পরিবেশকে সামনে রেখে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে বলে ইতোমধ্যে অনেকে এ বিষয়ে অবদান রাখছে। সুতরাং বিশ্ব পরিবেশ দিবসের গুরুত্ব যে অশেষ, তার নিঃসন্দেহে বলা যায়।
বাংলাদেশের বিশ্ব পরিবেশ দিবস : বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর ৫ ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হয়। দিবসটিকে ঘিরে নানারকম পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গণ পৃথক বাণী দেন এ দিবসে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পরিবেশ সংরক্ষণে জনমত গঠনে সচেষ্টা থাকে। নানা স্লোগান ও কর্মোদ্যোগে দিবসটিকে সফল করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর সচেতনতা সর্বজনের কামনা।
উপসংহার : পরিবেশ আমাদের বন্ধুর মতো। আমাদের জীবনের সুন্দর-সুস্থ বিকাশ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই পরিবেশ রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সকলের। মূলত পরিবেশ রক্ষার জন্যই জাতিসংঘ ৫ ই জুনকে বিশ্ব পরিবেশ দিবস হিসাবে ঘোষণা দিয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের সবার সচেতনতা কাম্য।
অন্যান্য রচনা
নারীশিক্ষা
বিজয় দিবস
তোমার প্রিয় লেখক (মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়)