অথবা, পলিথিন মুক্ত পরিবেশ
অথবা, পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ
ভূমিকা : পলিথিন হচ্ছে আমাদের সকলেরই প্রয়োজনীয় একটা জিনিস। কিন্তু এই পলিথিনই মানবজীবন এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। আমরা এই পলিথিন ব্যবহার করে পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছি হুমকির মুখে। অন্যদিকে পলিথিন শহরের ড্রেনেজ ও স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা ব্যবহারের অযোগ্য করে তুলেছে। এমনকি ফুটপাতের পাশে দখল করে আছে আবর্জনা স্তুপ। যেখান থেকে ছড়াচ্ছে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ পানি বাহিত নানা রোগ। ডেঙ্গু ও ম্যালেরিয়া আবাসস্থল তৈরির প্রধান ভূমিকা হচ্ছে পলিথিন। তাই সকলে এই সর্বনাশা পলিথিন বন্ধের দাবি চাই।
পলিথিন কী : পলিথিন হচ্ছে এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থ। পলিথিন মূলত তৈরি হয় মারাত্মক বিষাক্ত প্রোপাইলিনের সঙ্গে পেট্রোলিয়াম হাইড্রোকার্বনের ৩/৪ টি মলিকুলের সংমিশ্রে। বিজ্ঞানের পরিভাষায় এর নামকরণ করা হয়েছে পলিথাইলিন। অন্য পদার্থ গুলো ভেঙে অন্যান্য পদার্থে রূপান্তরিত করা যায়। কিন্তু পলিথিন ভেঙে অন্য কোন পদার্থে রূপান্তিত করা যায় না। কোন অনুজীব তার খাদ্য হিসেবে পলিথিনকে কখনোই গ্রহণ করে না। এজন্য পলিথিন পচে না।
পলিথিনের ক্ষতিকর দিক : পলিথিন আমাদের উপকার করে ঠিকই কিন্তু তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি ক্ষতি করে। বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছে যে, ঢাকা শহরে নিয়মিত প্রায় ১ কোটির অধিক পলিথিন ব্যাগ ব্যবহৃত হয়। মারাত্মক রোগের প্রধান সূত্রপাত হচ্ছে পলিথিনের ব্যবহার। পলিথিন ব্যাগে রাখা খাবারগুলো গ্রহণের ফলে চর্মরোগ, ক্যান্সারসহ নানা রোগের সৃষ্টি হয়। রঙিন পলিথিনগুলোতে ব্যবহার করা হয় ক্যাডমিয়াম যা ভয়ংকর বিষাক্ত, এর প্রভাবে স্বাস্থ্যের নানা সমস্যা দেখা দেয়। অন্যদিকে বায়ু দূষণের অন্যতম কারণ পলিথিন। যখন পলিথিন ভস্মীভূত করা হয় তখন এক ধরনের গ্যাসের উৎপন্ন হয় সেই গ্যাস বায়ুকে বিষাক্ত করে তোলে।
পরিবেশের উপর পলিথিনের প্রভাব :
১. মাটির অনুর্বরতা বৃদ্ধি : কৃষি গবেষণায় দেখা গেছে পলিথিন ব্যাগ মাটিতে পড়ে থাকার জন্য মাটির উর্বরতা হ্রাস করে এমনকি মাটির গুনাগুন নষ্ট করে। মাটির ভিতরে থাকা পলিথিন বাতাস থেকে অভ্যন্তরে অক্সিজেন প্রবেশে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। যার ফলে মাটির অভ্যন্তরে সূর্যের আলো পৌঁছাতে পারে না। যে কারণে মাটির উপকারী অনুজীব গুলোর মৃত্যু হয়। তাই মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যায়।
২. বায়ু দূষণে পলিথিন : আমাদের দেশে পলিথিনের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হয় দুটি রাসায়নিক পদার্থ, যথা: পলি প্রোপাইলিন ও পলি ইথিলিন। পলিথিন গলিয়ে মন্ড তৈরি করা হচ্ছে। এই মন্ড তৈরির প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এখান থেকে মিশ্রিত হয় কার্বন, কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন-মনোক্সাইড সহ দূষিত রাসায়নিক যৌগ, এছাড়াও এখান থেকে নির্গত হয় কালো দোয়া যা বাতাসকে মারাত্মক দূষিত করে।
৩. পানি প্রবাহের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি : শহরের ড্রেনেজ ও সুয়ারেজ ব্যবস্থা পলিথিন যেমন অচল করে রেখেছে, তেমনি গ্রামাঞ্চলের খাল- বিল, নদী- নালায়ও পলিথিন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এক জরিপে পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে ৩/৪ ফুট পুরু পলিথিনের আস্তর পড়ে আছে। যে কারণে ড্রেসিং করা সম্ভব হচ্ছে না। ড্রেজারের কাটারে বালির পরিবর্তে উঠছে পলিথিন। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের নদ-নদী এবং খাল বিলের তলদেশে প্রচুর পরিমাণে পলিথিন জমে আছে। যে কারণে পানি প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করছে।
৪. পয়ঃনিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা : ঢাকা মহানগরীর পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে মূলত এই পলিথিনের কারণে এমনকি ড্রেনের পাইপ গুলোর মধ্যে দিয়ে জমে রয়েছে লক্ষ লক্ষ পলিথিন, যার করণে শহরের স্যুয়ারেজ ব্যবস্থার ৮০% ভাগ অকার্যকর হয়ে পড়েছে।
৫. অর্থনীতিতে পলিথিনের প্রভাব : বর্তমানে পলিথিন ব্যাগ এর ব্যবহার অত্যাধিকভাবে বেড়েছে এজন্য পাট ও চটের ব্যাগের ব্যবহার নেয় বললেই চলে। ফলে দেশের পাটের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। পাটের উৎপাদন হ্রাস পাওয়ার কারণে পাটশিল্প গুলো লোকসানী শিল্পে পরিণত হয়েছে। এই শিল্প গুলোতে জড়িত ছিল হাজার হাজার কর্মচারী এবং শ্রমিক। চটের ব্যাগ, বেতের সামগ্রী, কাগজের ব্যাগ ইত্যাদি তৈরির সাথে মিশে ছিল লক্ষ লক্ষ দরিদ্র মানুষ যারা বেকারত্তের শিকার হয়েছে। যা আমাদের দেশের অর্থনৈতিক জন্য ভয়ংকর হুমকিস্বরূপ।
পলিথিন নিষিদ্ধকরণে সরকারের উদ্যোগ : পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদে প্রথমদিকে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরবর্তীতে পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপর সেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরিবেশ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নেয় সারাদেশে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হবে। প্রথম পদক্ষেপ ছিল ঢাকা শহরে ১ জানুয়ারি ২০০২ থেকে পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। পরে সারাদেশে সরকার পলিথিন ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তারপর পলিথিন ব্যবহারের পরিবর্তে ব্যবহৃত হতো কাপড়ের ব্যাগ, কাগজের ব্যাগ কিংবা চটের ব্যাগ। তখন থেকে পলিথিন ব্যাগ এর ব্যবহার আর দেখা যায় না। মানুষ বেশ উৎসাহের সাথে পলিথিন ব্যাগের পরিবর্তে ব্যবহার করতে শুরু করলো পাটের ব্যাগ, কাপড়ের ব্যাগ, ও চটের ব্যাগ। যে মানুষগুলো একসময় পলিথিন কুড়িয়ে জীবনধারণ করত পরবর্তীতে তারাও পলিথিন ব্যবহারের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছে।
উপসংহার : পরিবহন ও সংরক্ষণের ক্ষেত্রে পলিথিন আমাদের সাময়িক সুবিধা দিলেও অন্য দিকে পলিথিন ব্যাগের কোনো উপকারিতা নেই। এজন্য সকল নাগরিকের পলিথিন ব্যাগের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখা প্রয়োজন। আমাদের সকলের উচিত নিজ নিজ স্বার্থ ত্যাগ করে জাতীয় স্বার্থে মূল্য দিয়ে পলিথিন রোধে সোচ্চার হওয়া জরুরি। পরিবেশ ও জনজীবন রক্ষার জন্য বর্তমান সরকারের উচিত পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার কঠোরহস্তে বন্ধ করা, পাশাপাশি পলিথিন বন্ধে গৃহীত আইনের যথাযথ প্রয়োগ। পলিথিন রোধে প্রত্যেক নাগরিককে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই আমরা পেতে পারি পলিথিন মুক্ত একটি নির্মল পরিবেশ।
পলিথিন মুক্ত বাংলাদেশ ও পরিবেশ বিশুদ্ধকরণ PDF Format
অন্যান্য রচনা
বন্যা ও প্রতিকার
সময়ের মূল্য
একটি শীতের সকাল