অথবা, শীতকাল
ভূমিকা : শীতের সকাল সত্যিই মনোমুগ্ধকর। মূলত শীত আসে ঋতুচক্রের আবর্তে। মাঠ ভরা হেমন্তের ফসল যখন শূন্য ও রিক্ত হয়ে পড়ে, তখনই উপলব্ধি করা যায় শীতের আগমন। পৌষ এবং মাঘ মাসে শীতের তীব্রতা বেশি থাকার ফলে বাংলায় এ দুই মাসকে বলা হয় শীতকাল। প্রকৃতিতে আসে নানা পরিবর্তন তার পাশাপাশি পরিবর্তন আসে মানুষের জীবনযাত্রাতেও। বাংলার শীতের সকাল সত্যি অসাধারণ।
সূর্যোদয়ের পূর্বের শীতের সকাল : শীতের সকালে সূর্যটা যখন পূর্ব আকাশে উঁকি মারে তারপরেও মানুষ নিদ্রা ছাড়ে না। কেউ বা লেপের নিচে কেউ বা কম্বলের নিচে মুড়ি দিয়ে চুপটি করে শুয়ে থাকে। তবে তা বেশিক্ষণ নয়। কাকের ডাক ও মোরগের ডাকে ঘুম ভেঙে, সকলে শরীরে কাপড় জড়িয়ে আগুনের পাশে বসে আগুন পোহাতে। অন্য দিকে দেখা যায় কনকনে শীতকে উপেক্ষা করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগন ছুটতে থাকে মসজিদের দিকে। কৃষকেরা লাঙ্গল ও গরু নিয়ে মাঠের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। তাদের শরীরে থাকে সামান্য শীতের বস্ত্র। আবার কারো কারো গায়ে কোন শীতের বস্ত্রই থাকেনা। কাঁপতে কাঁপতে চলতে থাকে মাঠের দিকে।
শীতের স্বরূপ : সত্যিই শীতের সকাল হচ্ছে আমেজি। শহর কিংবা গ্রামে রাত শেষে ভোর হলেও ভোরে ওঠার সাময়িক মানসিক অবস্থা থাকে না। মনে হয় আরো কিছুক্ষণ লেপ/ কম্বল মুড়ি দিয়ে থাকি। উঠব উঠব করে আর উঠতে ইচ্ছা করে না। অপরদিকে শান্তময় প্রকৃতি ভোরের আবছা আলো-আঁধারিতে রহস্যঘন রূপ নিয়ে প্রকৃতির বুকে আশ্রয় নিতে হাতছানি দেয়।
বাংলাদেশ হচ্ছে ষড়ঋতুর দেশ। সৌন্দর্যের ঢালি সাজিয়ে একের পর এক ঋতুর আগমন হয়,তারপর শুরু হয় বাংলার প্রকৃতির নানা রূপ ধারণ। বিচিত্র এবং মিশ্র অনুভূতির সৃষ্টি করে এইসব ঋতুপরিক্রমা। হেমন্তের পরে শীতের আগমন হয়, প্রকৃতি তখন সন্ন্যাসী ও রিক্ততার রূপ ধারণ করে। বন বনানীর বুকে গাছের ঝরা পাতার সুর ভেসে আসে। আর তখনই শীত নিয়ে আসে তার ফুল, ফল ও ফলের ঘ্রাণ এবং সৌন্দর্য। শীতকালে গাধা, ডালিয়া, রজনীগন্ধা ও সূর্যমুখী ফুল দেখা যায়। অন্যদিকে ফলের মধ্যে দেখা যায় বরই, জলপাই, তেতুল, সফেদা ও কমলা। এসব উপহার দিয়ে শীতকাল নিজেকে ধন্য মনে করে।
শীতের সকালের সুবিধা : বাংলাদেশ হচ্ছে গ্রাম প্রধান। এজন্য শীতের সকালে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে বিভিন্ন রকমের পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যায়। এ সময় বিভিন্ন ধরনের পিঠার সমাহার ঘটে। খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি হয় মজাদার পায়েস। তীব্র শীতে খেজুরের রস খেতে পরিতৃপ্তি মনে হয়। শীতের সকালের মিঠে রোদ প্রশান্তি লাগে। এমনকি ঠান্ডার কারণে কোন খাবারই নষ্ট হয় না। জমাট বাঁধা মাছের তরকারি এবং পান্তা ভাত খাওয়ার মধ্য রয়েছে এক অন্যরকম আনন্দ তা বলে শেষ করা যায় না।
শীতের সকালের অসুবিধা : শীতের সকালে ঘন কুয়াশার কারণে কোন কিছুই সঠিকভাবে দেখা যায় না। প্রচন্ড শীতে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক থাকে না। কুয়াশায় রাস্তাঘাটের চলাচলকৃত যানবাহন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। শীতকাল দরিদ্র মানুষের জন্য অভিশাপ, কারণ শীতকালে শীত নিবারণের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় বস্ত্র থাকেনা। অনেকে শীতের সকালে কাজে যেতে অস্থিরতা বোধ করে।
গ্রামবাংলার চিত্র : বাংলার গ্রামে গ্রামে শীতের সকাল সত্যি অতুলনীয়। প্রকৃতি যেন কুয়াশায় চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। শীতের সকালে নদীর দৃশ্য দেখলে মনে হয় সুন্দরের প্রতিচ্ছবি। নদীর জলীয়বাষ্প যখন বাতাসের সাথে মিশে যায় তখন এক অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চলের শীতের সকাল মানুষের জন্য খুবই কষ্টকর কেননা তীব্র শীত নিবারণের জন্য অনেকের প্রয়োজনীয় বস্ত্র থাকেনা। এমনকি তীব্র শীতকে উপেক্ষা করে তাদের মাঠে যেতে হয় কাজের উদ্দেশ্যে। চাষীর বউরা ধান মাড়াই এবং ধান সিদ্ধ করার পাশাপাশি নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। সকালের মিষ্টি রোদ জ্যোতি ছড়িয়ে দেয় দুর্বার মাঠে। অন্যদিকে সূর্যালোকিত শিশির কণাগুলো দিকে তাকালে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এই শিশিরঝরা রূপটি মানুষের কাছে এক অনাবিল প্রশান্তি।
শহরের চিত্র : গ্রাম অঞ্চলে শীতের সকাল এবং শহরের শীতের সকালের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কেননা শহরে শীতের সকাল আসে একটু দেরিতে। দেয়ালগাত্রের মাঝে উদার আকাশের দেখা মেলে না। চাকরিজীবীরা ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়ো করে রওনা হয় অফিসের উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে দরিদ্র শ্রেণীর লোকেরা হালকা পোশাকে গুটিসুটি হয়ে বসে থাকে রাস্তা ঘাটে।
শীতের সকালে নদ নদীর দৃশ্য : শীতকালে নদীর দিকে তাকালে কুয়াশা এবং নদীর পানি আলাদা করে দেখা যায় না। শীতে নদ নদীর পানি শুকিয়ে যায়। এই কুয়াশাকে উপেক্ষা করে ছুটে চলে নৌকা ফেরি ও লঞ্চ। আর তখন নদীর উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঠান্ডা বাতাসে গা কেঁপে ওঠে।
শীতের সকালে ভাবনা : শীতকালে মানুষের মাঝে বিরাজ করে আলসেমী। কেন জানি মনে হয় লেপের মাঝে শরীরটাকে গুটিয়ে রাখি। কিন্তু বাইরের মিষ্টির রোদ দেখলে মনটা কেমন যেন খুশিতে মেতে ওঠে। শীতকালে সবথেকে আকর্ষণীয় এবং মজাদার হচ্ছে তাজা খেজুরের রস এবং নানা ধরনের পিঠা ও খেজুর পাটালীর পায়েস। চারিদিকে শীতের ফুটে থাকা ফুলের গন্ধ এবং শাকসবজি যেন খুশির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়।
রূপ বদল : শীতের সকালে সূর্যের তাপ বৃদ্ধি হওয়ার ফলে কুয়াশার জাল ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বেলা বাড়তে থাকে সূর্যের গরম তাপের প্রভাবে জাগ্রত হয়ে ওঠে ধরণী। এমনকি এ সময় দিন ছোট এবং রাত বড় হয়।
মানব জীবনের শীতের প্রভাব : শীতের প্রভাব সকল মানুষের জীবনে এক রকম নয়। শহরের বৃত্তশালীরা হাড় কাঁপানো শীত উপলব্ধি করতে পারেনা। অন্যদিকে দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ শীতের কাপড় না থাকার ফলে তাদের জীবন বাঁচানো কষ্টকর হয়ে ওঠে।
নানা রঙের পোশাকের ছড়াছড়ি : শীতকালে প্রকৃতি যেমন সজ্জিত হয়ে ওঠে তেমনি মানুষও অপরূপ সাজে সজ্জিত হয়। এ সময় মানুষ কঠোর শীত থেকে বাঁচার জন্য নানা রকমের গরম কাপড় পরিধান করে। কাপড় গুলোর রং এবং ডিজাইন আকর্ষণীয়। বিশেষ করে মহিলা এবং শিশুদের পোশাক চোখে পড়ার মত যা দেখতে সত্যিই অসাধারণ।
ভ্রমণে উপযুক্ত সময় : বাঙালি হচ্ছে ভ্রমণ পিপাসু। শীত ঋতু হচ্ছে ভ্রমণের নির্দিষ্ট সময়ে। তাই ভ্রমণপিপাসু বাঙালি শীত ঋতুকে সঙ্গী করে ছুটে চলে প্রকৃতির রূপ-বৈচিত্র ও সৌন্দর্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে।
উপসংহার : শীতের সকালের দৃশ্য দীর্ঘমেয়াদি হয় না। কেননা সূর্য ওঠে আবার ধীরে ধীরে রোদ ছড়িয়ে পড়ে যার ফলে উত্তাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনকি রাতে ঝরা শিশিরের কণাগুলো তার দায়িত্বের সমাপ্তি ঘটিয়ে উধাও হয়ে যায়। তীব্র শীতের প্রভাব কাটিয়ে মানুষ বেরিয়ে পড়ে তাদের কর্মক্ষেত্রে। এবং শরীর থেকে মুছে ফেলে কুয়াশায় ঘেরা শীতের সকাল।
অন্যান্য রচনা
জীবন গঠন ও চরিত্র
বন্যা ও প্রতিকার
সময়ের মূল্য